যোগেন্দ্রনাথ সেন, ছোট করে বললে: জন সেন। আমাদের অনেকেরই অপরিচিত যোগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন ভারতীয় সৈনিক, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি সৈনিক যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় মারা গেছেন। সুতরাং চলুন জেনে আসা যাক, যোগেন্দ্রনাথ সেনের অজানা জীবন সম্পর্কে।

ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই বাঙালির পুরো নাম ছিলো যোগেন্দ্রনাথ সেন, তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সময় তিনি নামটিকে ছোট করে জন সেন রাখেন। যোগেন্দ্রনাথ সেন তৎকালীন বাংলার একটি ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। চন্দননগরেই বড় হয়েছেন বিধবা মায়ের কাছে। যোগেন্দ্রনাথ সেনের বড় ভাই ছিলেন একজন ডাক্তার। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে যোগেন্দ্রনাথ সেন পড়ালেখার জন্য চলে যান ইংল্যান্ডে। আর ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
   

যোগেন্দ্রনাথ সেন

মেধাবী যোগেন্দ্রনাথ সেন ভর্তি হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পড়াশোনার বিষয় ছিলো বৈদ্যুতিক কারিগরীবিদ্যা। পড়াশোনাকালীন সময়ে তিনি চাকরি করতেন হোয়াইটহল রোডের লিডস কর্পোরেশনের ইলেকট্রিক লাইটিং স্টেশনে। যোগেন্দ্রনাথ সেন বিশ্বের সাতটি দেশের ভাষা জানতেন বলে জানা গেছে। ১৯১৩ সালে লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে যোগেন্দ্রনাথ সেন থাকতেন লীডস শহরের ব্ল্যাকম্যান লেনের গ্রসভেনর প্লেসে।

১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যোগেন্দ্রনাথ সেন ১৫ তম ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের লীডস প্যাল্স ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। প্যাল্স ব্যাটালিয়ন (Pals battalion) ছিলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে অঞ্চল ভিত্তিক গড়ে ওঠা সৈন্যদল, যারা সাধারণত একে অপরের সাথে পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৫ তম ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ সদস্য ছিলেন বাঙ্গালি যোগেন্দ্রনাথ সেন।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অশ্বেতাঙ্গরা যেমন বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পায় না, ঠিক তেমনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগেন্দ্রনাথ সেন তার অধিকাংশ সহকর্মীর চেয়ে বেশি শিক্ষিত হয়েও শুধুমাত্র অশ্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে সৈনিক থেকে অফিসার পদে উন্নীত হতে পারেননি। তবে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে তার অনেক সুনাম ছিলো।

সহযোদ্ধাদের মাঝে জন সেন

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে হয়তো নিজেকে নিয়ে অনেক গর্বিত হতে পারতেন যোগেন্দ্রনাথ সেন, কিন্তু জীবনের শেষ দিকে তিনি তার বিধবা মায়ের সাথেও একবার দেখা করতে পারেননি। ঐতিহাসিক ব্যাটেল অফ দ্য সোমে'তে (Battle of the Somme) যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের বাইশে মে রাতে ব্যাপক বোমাবর্ষণে গুরুতর আঘাত পান যোগেন্দ্রনাথ সেন। এসময়ে তিনি কর্মরত ছিলেন ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের ওয়ারিং পার্টিতে (wiring party), যেখানে তাদের কাজ ছিলো রাতের বেলা সমরাঙ্গনে শত্রুপক্ষের সাজানো কাঁটাতার কেঁটে ফেলা এবং স্ট্রাটেজিক কৌশল হিসেবে কিছু স্থানে নিজেদের কাঁটাতার সাজানো। প্রথমে পায়ে এবং পরে ঘাড়ে বোমার প্রানঘাতী শ্রাপনেলের আঘাতের তাৎক্ষনিকভাবে মারা যান যোগেন্দ্রনাথ সেন।  


ইন্সটিটিউট ডি চন্দননগরে যোগেন্দ্রনাথ সেনের চশমা এবং ছবি

এই বীর বাঙালিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে ফ্রান্সের কলিনক্যাম্পস সামরিক সমাধিস্থলে। যুদ্ধের পরে তার ব্যবহার করা দৈনন্দিন জিনিসগুলো তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছিলো, যা তার ডাক্তার বড়ভাই চন্দনগরের ইন্সটিটিউট ডি চন্দননগরে (Institut de Chandernagore) দান করে দেন।

মাত্র তিন দশকের ছোট্ট জীবনে যোগেন্দ্রনাথ সেন হয়তো এই অবাক পৃথিবী অনেক কিছুই দেখেননি, কিন্তু ইতিহাসের সোনালি পাতায় তাকে আজীবন দেখা যাবে। এই বাঙালির গল্প হয়তোবা তেমন জনপ্রিয় হবে না এবং অনেকেরই অজানা থেকে যাবে। তবে ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো বীরের কীর্তি মুছে যায়না বলে তিনি অসংখ্য লাইব্রেরির বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকবেন। কোনো উৎসাহী পাঠক হয়তো বইটি খুলে একটু পড়বে তারপর আবার রেখে দিবে। এভাবেই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোগেন্দ্রনাথ সেন ওরফে জন সেন।
ইউসুফ হাসান আদিত্য
অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া ইউসুফ হাসান আদিত্য ঝামেলা পাকাতে উস্তাদ। আবিষ্কার আর বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে তার রয়েছে অসীম আগ্রহ।