গ্রীসের পার্থেনন

পৃথিবীব্যাপী মানুষের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র ধরা হয় জাদুঘরকে। জাদুঘরে সংরক্ষিত নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের প্রতিনিয়ত প্রাচীন মানুষ এবং সভ্যতার ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে থাকে। অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর মানুষ অতীতের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সংগ্রহশালা বানিয়ে আসছে। প্রাচীন যুগের রাজা বাদশাহ এবং শৌখিন মানুষেরা নিজেদের সংগ্রহশালায় সংরক্ষন করতেন বিচিত্র সব মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। তবে সেসব সংগ্রহশালার অধিকাংশই ছিলো ব্যক্তিগত কিংবা অভিজাত সমাজের জন্য নিবেদিত। যেমন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ব্যবিলনীয় রাজকন্যা এনিগালডির তত্ত্বাবধানে থাকা সংগ্রহশালাকে অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্বের প্রাচীনতম জাদুঘর মনে করে থাকেন।

অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর

ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর প্রথম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত আধুনিক জাদুঘর হিসেবে দাবি করা হয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘরকে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গুনী ছাত্র এলিয়াস অ্যাশমোল নিজের সংগ্রহে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক তাৎপর্য বিশিষ্ট নানান সংগ্রহ নিয়ে জাদুঘরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ১৬৮৩ সালে।

রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

আর এদিকে আমাদের বাংলাদেশে স্থাপিত সর্বপ্রথম জাদুঘরটি হলো রাজশাহী জেলায় অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৯১০ সালে রাজশাহী এবং নাটোরের জমিদারদের ব্যক্তিউদ্দ্যোগে যাত্রা শুরু হওয়া জাদুঘরটির তত্ত্বাবধান করে থাকে দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।  

ব্রিটিশ মিউজিয়াম

এবার আসি জাদুঘর এবং উপনিবেশ সংক্রান্ত সম্পর্কের বিষয়টিতে। বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্য ঐতিহ্যগুলো উপস্থাপন করে অনেক সময় আড়াল করা হয় বিশ্বখ্যাত জাদুঘরগুলোর অন্ধকার ইতিহাসকে। কেননা বিশ্বের অধিকাংশ তাৎপর্যপূর্ণ জাদুঘরগুলোর প্রদর্শনীতে স্থান পায় লুটতরাজ করে ছিনিয়ে আনা অন্য কোনো জাতিসত্ত্বার মূল্যবান ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কথা। উপনিবেশগুলো থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে আনা প্রত্নসামগ্রীর রীতিমতো পাহাড় গড়েছে ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়াম। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সংগ্রহে থাকা ৮০ লাখ প্রত্নসামগ্রীর মাত্র ১% তারা তাদের উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে স্থান দেয়, যার অধিকাংশই সাবেক উপনিবেশগুলোর ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। তবে সাবেক শোষকদের অন্যায় নিয়ে অধিকাংশ নতুন উপনিবেশবাদীদের কোনো মাথাব্যথা নেই বললেই চলে।

 

কোহিনুর হীরা

ইংল্যান্ডের টাওয়ার অফ লন্ডনে অন্যান্য রাজকীয় অলংকারের সাথে সংরক্ষিত আছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত কোহিনুর হীরা। স্বাধীনতার প্রথম থেকেই ব্রিটিশ রাজমুকুটে স্থান পাওয়া এই হীরাটিকে ফেরত চেয়ে আসছিলো ভারতীয় সরকার। বরাবরই নির্লজ্জের মতো এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারাই এই হীরাটির প্রকৃত হকদার যেহেতু পাঞ্জাবের মহারাজা দুলীপ সিং লাহোর চুক্তির মাধ্যমে প্রথম এংলো- শিখ যুদ্ধের ইতি টানেন এবং হীরাটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে দেন।

 

সর্বশেষ শিখ মহারাজা দুলীপ সিং

অথচ প্রকৃতপক্ষে সেসময় শিখ সাম্রাজ্যের শেষ মহারাজা দুলীপ সিংয়ের দশ বছর বয়সও হয়নি। মহারাজা দুলীপ সিংকে সেই সময়ে এই অন্যায় চুক্তিতে বাধ্য করা হয় এবং নিজের মায়ের কাছ থেকে নির্বাসিত করা হয়।

নাইজেরিয়ার বেনিন ব্রোঞ্জ

সাম্প্রতিক সময়ে বেনিন ব্রোঞ্জ খ্যাত  অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানির নৃতত্ত্ব জাদুঘর এবং স্কটল্যান্ডের এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ লুটেরারা ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে ধুলিসাৎ করে দিয়ে, ১৮৯৭ সালে নাইজেরিয়ার সমৃদ্ধশালী কিংডম অফ বেনিনে ব্যাপক রক্তাক্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং হাজারো মূল্যবান মূর্তি চুরি করে। পরবর্তীতে যা স্থান পায় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম পরে অনেকগুলো মূর্তি চড়া মূল্যের নিলামে বিক্রি করে ইউরোপব্যাপী ছড়িয়ে দেয়। ২০২০ এর ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের পরে ব্রিটিশ মিউজিয়াম আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বেনিন ব্রোঞ্জ খ্যাত এই পুরাকীর্তিগুলো নাইজেরিয়ার বেনিন শহরে নবনির্মিত একটি জাদুঘরে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়েছে। তবে ঠিক কি প্রক্রিয়ায় কতগুলো মূর্তি ফেরত যাবে তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম।

পার্থেনন মার্ভেলস

এদিকে যখন ফরাসি সরকার আফ্রিকান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পত্তিগুলোকে ফিরিয়ে দিতে আইন প্রণয়ন করছে, তখন নৈতিকতার প্রশ্নে ক্রমাগত জর্জরিত হচ্ছে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিউজিয়াম। যেমন ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার বিতর্কে স্থান পেয়েছে পার্থেনন মার্ভেলস খ্যাত অনন্য গ্রীক শিল্পকর্ম। গ্রীসে অটোমান শাসনামলে গ্রীক দেবী এথেনার মন্দির থেকে ব্রিটিশ লর্ড এলগিন অবৈধভাবে ৫০% ভাস্কর্য নিয়ে আসেন ইংল্যান্ডে, পরে যা ক্রয় করে নেয় ব্রিটিশ মিউজিয়াম। বিগত ২০০ বছর ধরে গ্রীস এই মূর্তিগুলো ফেরত চাইলেও তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ইংল্যান্ড।

অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিনাল আদিবাসী


জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব তার আসল হকদারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার অনেক নজিরই অতীতে দেখতে পাওয়া যায়।

২০১৯ সালে আমেরিকার ইলিনয়েস স্টেট মিউজিয়াম অস্ট্রেলিয়ার এবরিজিনাল আদিবাসীদের কাছে পবিত্রগন্য হয় এমন বেশ কিছু প্রত্নতত্ত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে। এবরিজিনাল আদিবাসীদের দাবির ভিত্তিতে ব্রিটিশদের কাছে থাকা এরুপ ৩২০০০ নিদর্শনের উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ফেরত পাওয়ার জন্য কাজ করছে অস্ট্রেলিয়ার শিল্প এবং যোগাযোগ মন্ত্রনালয়। লেবার পার্টির দুইজন এমপিও ব্রিটিশ সরকারকে এগুলো ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

 

তুরস্কে পাওয়া যাওয়া অর্ফিউসের মোজাইক আর্ট

২০১২ সালে আমেরিকার ডালাস মিউজিয়াম অফ আর্টস, তুরস্ককে গ্রীক উপকথার অন্যতম চরিত্র অর্ফিউসকে কেন্দ্র করে আঁকা একটি মোজাইক শিল্প কর্ম ফেরত দেয়, কেননা জাদুঘর কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, শিল্পকর্মটি অবৈধভাবে তুরস্কে অবস্থিত একটি গ্রীক স্থাপনা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো।

২০১০ সালের নভেম্বরে জাপান সরকার দক্ষিন কোরিয়াকে ১০০০ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ফিরিয়ে দেয়, যা কোরিয়ায় জাপানের ৩৫ বছরের উপনিবেশিক শোষনের সময় লুট করা হয়েছিলো।

 

ঐতিহাসিক স্টোন অফ স্কোন

সাবেক উপনিবেশ থেকে লুট করা সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার বিতর্ক মূলধারায় আসার বহু আগে, ব্রিটিশ সরকার ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক কারণে, স্কটল্যান্ডকে স্টোন অফ স্কোন খ্যাত একটি বিখ্যাত পাথরের টুল ফেরত দেয়, যাতে বসে স্কটিশ রাজাদের অভিষেক করানো হতো। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, এই পাথরটির সত্যতা ও অস্তিস্ত নিয়ে বিতর্ক আছে এবং ১৯৫০ সালের বড়দিনে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে থেকে চারজন স্কটিশ ছাত্র পাথরটিকে চুরি করে স্কটল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন! সে অবশ্য আরেক ইতিহাস।


দিন দিন মানুষের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা কমছে। নয়া মেরুকরণের রাজনীতিতে বিভক্ত পৃথিবীতে তাই ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখাও দুরূহ হয়ে পড়ছে। সুতরাং লুট করা সম্পদগুলো হয়তো বিশ্বের অধিকাংশ জাদুঘরই ফেরত দিবেনা সম্পদগুলোর প্রকৃত হকদারদের কাছে। তবে আধুনিক বিশ্বের সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ মানুষের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করবে এবং পূর্বজদের ঐতিহাসিক ভুলোগুলোকে উদারতা এবং মহানুভবতার সাথে সমাধান করবে। 

আশরাফুল আলম প্রান্ত
ইতিহাসনামা.কম এর তিনজন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সময় অপচয় করা তার মুদ্রা দোষ।