চিত্র ১ঃ নিজামির ইস্কান্দরনামার একটি চিত্র



এক.  

সুলতানি আমলের চিত্রকলাঃ 

পাল যুগের চিত্রকলা এবং সুলতানি চিত্রকলার মধ্যে সেতু তৈরি করে দেয় সেন শাসনামল। পাল রাজারা মূলত বৌদ্ধ ধর্ম্যালম্বী হলেও তারা যে পৌরাণিক হিন্দুধর্মের দেবদেবীদের বিগ্রহ ও মূর্তি তৈরি করে - এমন শিল্পীদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তার পরিচয় মেলে। কিন্তু দাক্ষিণাত্য থেকে আগত সেন রাজারা ছিলেন - বেদ-ব্রাহ্মণ তথা বর্ণাশ্রম আশ্রয়ী হিন্দুধর্মের উদ্যমী পরিপোষক। তাদের আমলে বাংলার বৌদ্ধ ধর্ম্যালম্বীরা নিগৃহীত হয়ে নেপাল এবং তিব্বতে স্থানান্তরিত হয় এবং সেই নিপীড়িত- বাস্তুচ্যুত বৌদ্ধ ধর্ম্যালম্বী শিল্পীদের সাথেই পূর্বভারতীয় চিত্রকৌশল যে নেপালে ছড়িয়ে পড়ে - তা ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত। 

চিত্র সমালোচক এবং ঐতিহাসিক অশোক ভট্টাচার্যের মতে, সেন রাজাদের চেয়েও বড় বিপর্যয় নেমে আসে বাংলার চিত্রকলায় - যখন ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খলজি সেন রাজ্যের শেষ রাজা লক্ষণসেনকে হঠিয়ে বাংলার মসনদে বসেন। নবদ্বীপ, পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গে সূচনা হয় সুলতানি শাসনামলের। তুর্কিরা ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির দিক থেকে বাঙ্গালীদের থেকে ছিল যোজন যোজন পৃথক। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল বৌদ্ধ এবং সনাতন ধর্ম্যালম্বী - এই উভয় জনগোষ্ঠী। 

সুলতানি শাসনামলের এই সূচনালগ্নটুকু বাদ দিলে দেখা যায় , চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলায় সুলতানি শাসনামলের এক নবযুগের উন্মেষ। ইলিয়াস শাহের (১৩৪২- ৫৭ খ্রি) শাসনামল থেকেই দেখা যায় বাংলার স্বাধীন সুলতানেরা দেশশাসনের ব্যাপারে হিন্দু জমিদার ও প্রশাসকগনের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়ায় চলে এসে দেশে সুশাসন প্রবর্তনে সক্ষম হন। রাজনৈতিক শক্তি এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতির বাহক হিসেবে বাংলা তখন সর্বভারতীয় স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়। বাংলার এসকল স্বাধীন সুলতানেরা ইসলামের অনুসারি হয়েও বাংলার দেশজ সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন, তা জানা যায় - রামায়ন, মহাভারত প্রমুখ সনাতন ধর্ম্যালম্বীদের ধর্মগ্রন্থসমূহের বঙ্গানুবাদে তাদের তৎপরতা দেখে। ইলিয়াস শাহী শাসনামলে আরম্ভ হওয়া এই পৃষ্ঠপোষকতা আরও বিস্তৃতি লাভ করে হুসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩- ১৫৩৮)। স্বয়ং হুসেন শাহ ছিলেন চৈতন্যদেবের গুণগ্রাহী আর শ্রী চৈতন্যদেব তাকে সুশাসক হিসেবে সম্মান প্রদর্শনে ছিলেন অকুণ্ঠ। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের আমলে দেশের সর্বাঙ্গীণ সমৃদ্ধির ফলে সাংস্কৃতিক বিকাশ এমন এক স্তরে পৌঁছেছিল, যার তুলনা চলে কেবল পাল শাসনামলের সাথেই। 

সুলতানি শাসনামলে নতুন শাসকবর্গ নিজস্ব উদ্যমে নতুন এক ধরনের স্থাপত্যরীতি শুরু করেন, গৌড়ের মসজিদ ও সমাধিসৌধগুলিতে এখনও যার পরিচয় পাওয়া যায়। মূলত পোড়ামাটির ইট ও টালিতে তৈরি এই স্থাপত্যকর্মগুলি নির্মিত হয়েছিল এদেশের কারিগরদের দিয়েই। টালি ও ইটের নকশায় যে জ্যামিতিক ও লতাপুষ্পের অলঙ্করণ দেখা যায় সেগুলি পশ্চিম এশিয়ার আরবীয় ও ভারতীয় নকশার সমন্বয়ে পরিকল্পিত। 



দুই. 

বাংলায় পারস্য চিত্রকলার আবির্ভাব প্রসঙ্গ 

 

চিত্র ২ঃ কোরআনের ক্যালিগ্রাফি


চতুর্দশ শতকের শেষদিকে, শেষ ক্ষমতাশালী তুঘলক সম্রাট ফিরোজ শাহের মৃত্যু (১৩৮৮) ও তৈমুর লং এর উত্তর ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের মতই উত্তর ভারত, গুজরাট, জৌনপুর ও বাংলার নবাবরাও নিজেদের স্বাধীন সুলতান বা শাসক হিসেবে দাবি করে। ভারতের চিত্রকলার ইতিহাসে এই সকল প্রাদেশিক সুলতানদের আছে বিশেষ অবদান। পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ এবং দক্ষিণ ভারতের জৈন পুঁথিচিত্রের সংমিশ্রণে এই সুলতানদের দরবারেই সূচনা ঘটে সম্পূর্ণ এক নতুন ধারার অণুচিত্র বা মিনিয়েচারের অনুশীলন। নতুন এই চিত্ররীতির উৎস হল পারসিক বা ইরানীয় পাণ্ডুলিপি চিত্রকলা। তবে পারসিক চিত্রকলার কোন পর্যায়ের ধারা এই সুদূর বাংলায় এসে পৌঁছেছে তা অনুধাবন করতে গেলে প্রয়োজন পড়ে কিছু ঐতিহাসিক আলোচনার। 

সেই আমলে বইয়ের প্রতি আগ্রহ অধিক পরিলক্ষিত হত মুসলিমদের মাঝেই, খ্রিস্টান কিংবা ইহুদীদের থেকে। ফলে, কোরআনের এক একটি পাতা অলঙ্করণ করে অনুকরণ করার জন্যে ক্যালিগ্রাফারকে দেয়া হত বিপুল পরিমাণ দক্ষিণা। কালক্রমে আরবি হরফের নানান রুপান্তর ঘটতে থাকে এবং সেই হরফ আলংকারিক চরিত্র অর্জন করে। প্রথম প্রথম ক্যালিগ্রাফির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরবীয় লতাপুষ্প দিয়ে সজ্জিত করা হত পাণ্ডুলিপির পাতাগুলি। তারপর, মুসলিম ইতিহাসের গ্রন্থগুলিতে প্রাথমিকভাবে দেখা গেল চিত্ররূপায়ন। তবে যেহেতু ইসলামী বিশ্বাসে প্রাণীর অনুকৃতি ছিল অসিদ্ধ, কাজেই সেই অলংকরন বা ছবিগুলিতে দেখা গেল আদর্শায়িত কল্পনাজাত এক রূপজগত। সে জগতের মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা সবই ছিল যেন ভিন্ন কোন এক রূপলোকের বাসিন্দা। উজ্জল বর্ণে রঞ্জিত এই সব ছবি পাণ্ডুলিপির গৌরব ও মূল্য বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। দক্ষ লিপিকর ও নিপুণ শিল্পীদের দ্বারা লিখিত ও সজ্জিত এইসব মুল্যবান গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধনী ও রুচিসম্মত অভিজাত মুসলমানরা। মুসলিম শাসকেরা বাইজেন্টাইন অধিকৃত করে নিলে সেই সংস্কৃতির চিত্রকলাকে দারুণভাবে আপন করে নেন মুসলিম চিত্রকরেরা। মধ্য এশিয়ার তুর্কমানেরা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের মাধ্যমে চীনা চিত্ররীতি এসে পৌঁছায় মুসলিম চিত্রকরদের কাছে। এইভাবে, প্রায় তিনটি শিল্পধারার পরম্পরা সংস্পর্শে এসে গড়ে ওঠে মুসলিম পাণ্ডুলিপি চিত্রের ঐতিহ্য। 


 

চিত্র ৩ঃ পারস্যের সাফাবি চিত্রশৈলীর সেরা শিল্পী বিহজাদের একটি চিত্রকর্ম


পারস্য চিত্রকলার যে ধারা বাংলায় এসে পৌঁছায়, তাকে চিত্র ঐতিহাসিকগণ নামকরণ করেছেন- সাফাবি চিত্রশৈলী। সাফাবি সুলতান শাহ ইসমাইল (১৫০১-১৫২৪) পশ্চিম পারস্যের তাব্রিজ শহরে রাজত্ব শুরু করবার পর অধিকৃত করে নেন পূর্ব পারস্যে অবস্থিত তৎকালীন পারস্যের শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্র হিরাট নগরটিকেও। তিনি তার পুত্র শাহ তাহমাস্পকে পড়াশোনার জন্যে প্রেরণ করেন ঐ নগরে। শুধু তাই নয়, নিজের দরবারের অধিভুক্ত করে নেন মহান শিল্পী বিহজাদকে, যিনি পরবর্তীতে শাহ ইসমাইল পুত্র শাহ তাহমাস্প যখন সিংহাসনে বসেন তখনও সম্রাটের বিশেষ আনুকূল্য লাভ করেন। তারা পিতাপুত্র মিলে চিত্রকর, কবি-শিল্পী ও দার্শনিকদের বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সাফাবি চিত্রশৈলীকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই মহান শিল্পী বিহজাদের প্রথম দিককার ধারাই এসে পৌঁছেছিল বাংলায়। সুলতান নসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ে নিজামি কর্তৃক রচিত ইস্কান্দরনামা বা 'আলেকজান্ডারের কাহিনী' নামের ৭২ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কিত ৯টি ছবিতে পারস্য চিত্রশৈলীর প্রমাণ জাজ্বল্যমান। ছবিগুলোতে কোন চিত্রকরের নাম দস্তখত না থাকায় ছবিগুলো এঁকেছে কে বা কারা, তা জানা যায় না। 

  

চিত্র ৪ঃ বিহজাদের আরেকটি চিত্রকর্ম, পারসিক মিনিয়েচার বা অনুচিত্রকর্মের নিদর্শন


ছবিগুলি পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধের পারসিক চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য বহন করলেও বিহজাদের নিজস্ব কিছু শৈলীর ছাপও বহন করছে বলে মনে হয়। বিশেষত রূপবিন্যাসের শৃঙ্খলায় এবং মানুষের আকৃতিতে সে ছাপ স্পষ্ট। আকাশের যে চিত্ররূপ ইস্কান্দরনামায় পাওয়া যায়- মেঘ, মেঘের আড়াল হতে বিচ্ছুরিত সূর্যালোক, তাতেও বিহজাদের অঙ্কনশৈলী প্রকাশমান। 

সুলতান শাহ তাহমাস্প চিত্রকলার প্রতি তার এই অতি দুর্বলতাকে ইন্দ্রিয়-পরায়ণতাজনিত মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ মনে করে সম্পূর্ণভাবে চিত্রকলার পৃষ্ঠ পোষকতা ত্যাগ করেন ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে। ফলে সাফাবি দরবারের অধিকাংশ শিল্পীকেই বাধ্য হয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে হয়। সাফাবি শৈলীর অন্ততপক্ষে চারজন যশস্বী শিল্পী - মির মুসাব্বির, মির সৈয়দ আলী, দোস্ত মোহম্মদ এবং আবদুল সামাদ ১৫৫০ সালে ভারতে সম্রাট হুমায়ূনের দরবারে চলে আসেন। সম্রাট আকবরের আগ্রহে ও আনুকুল্যে তাদের হাতেই দরবারি মুঘল চিত্রকলার সূত্রপাত হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হল, পারসিক শিল্পীরা তার আগেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিলেন নানা দিকে, যার মধ্যে অটোমান, উজবেগ এবং ভারতীয় বিবিধ প্রাদেশিক সুলতানদের রাজ দরবার। আর ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলার নসরত শাহ ছিলেন সেই পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। 



তিন. 

চৈতন্যদেব আশ্রিত বৈষ্ণব চিত্রকলার উন্মেষ 

 

চিত্র ৫ঃ কৃষ্ণের মথুরাযাত্রা


হুসেন শাহী বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানকার দরবারের পারসিক ও আরবিক সংস্কৃতির প্রভাব ছিল প্রবল। ফারসি ভাষা ছিল সরকারি ভাষা। আর সেই অনুষঙ্গেই পারস্য চিত্রশৈলী সুদূর পারস্য থেকে চলে আসে পূর্বভারতের গৌড়ে। 

হুসেন শাহের আমলেই বাংলার নবদ্বীপে আবির্ভাব ঘটে বৈষ্ণব ধর্মের যে মনিষীর তার নাম - শ্রীচৈতন্যদেব। তার ধর্ম প্রচারণার ভঙ্গী ছিল ভিন্ন ধরনের। প্রেমভক্তির ধর্মকে ভাবোন্মাদনার মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত করে, ধর্মীয় অনুভূতির সাথে শিল্পানুভূতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তার ধর্ম সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তার নিজের মধ্যেই ছিল ধর্মীয় ও কাব্যিক- এই দুই অনুভূতির সহাবস্থান। তার খ্যাতি ছিল - "সংকীর্তন-রস-নৃত্যবিহারী" নামে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতি স্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল তারই অনুপ্রাণিত "প্রেমভক্তি" নির্ভর বৈষ্ণব  ধর্মান্দোলনের ভিত্তিতে। কাজেই অনুমান করাই যায় - এহেন চৈতন্যদেবের ধর্মকে আশ্রয় করে নৃত্য-গীত-অভিনয়ের সাথে চিত্রকলার বিকাশ ছিল স্বাভাবিক।                                 

চৈতন্যদেবের সময়কালে ঠিক কি ধরনের চিত্রশৈলী নবদ্বীপে চর্চা হত- তার সরাসরি কোন বিবরণ আমরা পাই না। তবে চর্চা যে ছিল সেটা স্পষ্ট তৎকালীন লেখক - বংশীবদনের "শ্রীগৌরাঙ্গলীলামৃত" গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন - "শ্রীবাসমন্দিরে জনৈক ভাস্কর শ্রীগৌরাঙ্গকে শ্রীকৃষ্ণের গোদোহনলীলা চিত্রপটে প্রদর্শন করলে গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ ভাবাবেশে গোপলীলানুকরণ করে নৃত্য করেছেন"। এছাড়াও, জনসাধারণ্যের মাঝে ও গৃহস্থের জীবনে পূজাব্রততে আলপনা রচনা আর বিবাহে পিঁড়ি অঙ্কনের যে প্রচলন ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। 

বৈষ্ণবধর্মাশ্রিত সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা-স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের যে সৌকর্যে বাঙ্গালীর নিজস্ব রুপবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার কেন্দ্র সূচিত হয় বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুরের পাটাচিত্রের শৈলী পৃথক বর্ণনার দাবী রাখে। (চলবে)



লেখকঃ সাজিদ উল হক আবির

কথাসাহিত্যিক, গবেষক, ও অনুবাদক। তিনি ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনারত।