যখন মানবজাতি চন্দ্র অভিযান শেষ করে মঙ্গল গ্রহের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন পৃথিবীতেই কিছু মানুষ রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার দিয়ে খুন হচ্ছেন প্রতিদিন। চলমান অর্থনীতিতে যখন সকল দেশ জিডিপি বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক প্রসারে খুব বেশি মনোযোগী, সকল ভূখণ্ডে তখন মানবাধিকার হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত। দু'একটি প্রেস কনফারেন্স করে দায়সারা আচরণের মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন কর্তাব্যক্তিরা। দেশে দেশে চলমান এই রকম অসংখ্য সংকটের মধ্যে অন্যতম হলো জাতিগত সংঘাত।


প্রাচীন গ্রীক দেশ থেকে উৎপত্তি হওয়া দাসপ্রথা, কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শেতাঙ্গদের আধিপত্য আজও চলমান। কেবল যুগে যুগে বদলেছে এই

নিপীড়নের রূপ। নতুন সব উদ্ভাবনী শক্তি শোষণকে দিয়ে চলেছে এক ভিন্ন মাত্রা।


    


সম্প্রতি সারা বিশ্বে আলোড়ন তৈরি করা এমন একটি ঘটনার অবতারণা হয়েছে প্রভু রাষ্ট্র আমেরিকাতে। জর্জ ফ্লয়েড এর নির্মম মৃত্যু হাজারো মিনিয়াপোলিসবাসীকে রাস্তায় নামাতে বাধ্য করে। জনগণকে ন্যায়বিচারের দাবিতে যখন বিক্ষোভ করছিলো তখন পুলিশ প্রচলিত নিয়মেই ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশী জনস্রোতকে।

এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল 2014 সালে। নিউইয়র্ক সিটিতে কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নেরও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছিলেন একইভাবে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার তারা দুজনেই শ্বাসরোধ জনিত কারণে খুন হন পুলিশের হাতে। খুন শব্দটি ব্যবহার করার কারণ জবাবদিহিতাবিহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে চিহ্নিত করার জন্য।   



রাষ্ট্রপরিচালনার ভিত্তি  যখন হয় "পুঁজিবাদ" তখন দেশের জনগণকে মাপা হয় অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে। সমাজে বসবাসকারী মানুষকে ভাগ করে ফেলা হয় বিভিন্ন শ্রেণীতে। এই শ্রেণিবিন্যাসই শোষণের পিতা।



আমেরিকার শত বছরের ইতিহাস বলে, শ্বেতাঙ্গ মনিবের অধীনস্থ কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা আমেরিকার প্রগতির ধারক ও বাহক। এই মজুর শ্রেণীর ঘামে তিলে তিলে তৈরি হয়েছে আধুনিক আমেরিকা। আজ দাসপ্রথা নেই সত্যি তবে কৃষ্ণাঙ্গদের মিলেনি সামাজিক কোন অবস্থা তারা আজও পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে এমন কোন হীন কাজ নেই যার সাথে তারা জড়িত নয়। যখনই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রয়াস পায় তাদের নিষ্পাপ সন্তানেরা, স্কুলগুলোতে তখন নেমে আসে বর্ণবাদের খড়গ। ঝরে পড়া শিশুদের একসময় স্থান হয় কারাগারগুলোতে।



যুক্তরাষ্ট্রের সফল কালো মানুষগুলোর দিকে যদি আপনি তাকান তাহলে দেখতে পাবেন, তাদের অধিকাংশই এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত। মনোরঞ্জক হিসেবে তাদের সমাদর রয়েছে বটে তবে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তারা খুব বেশি বেমানান বলে বিবেচিত হন। সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণী কৃষ্ণাঙ্গদের নেই বললেই চলে, যখনই কোন ব্যক্তি সজাগ হন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের পরিণতি হয় ম্যালকম এক্স এবং মার্টিন লুথার কিং এর মত।


Afro-american দের মধ্যে যেহেতু বিশ্বের সেরা ধনীর নাম নেই, অফিস আদালত গুলোতে নেই দক্ষ জনবল, তখন তারা পাশ্চাত্যের প্রচলিত odd job গুলোতেই শ্রম দেন। আর রাষ্ট্রকাঠামো যখন ধনিক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষক তখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতির তলানিতে অবস্থানরত মানুষের মূল্যায়ন করেনা। এভাবেই মূল্যায়িত না হওয়ার দরুণ জনগণের করে কেনা অস্ত্র দিয়ে জনগণ নিহত হচ্ছে তাদের সেবায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের দ্বারা।



অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এর সমাধান খুঁজলেও, সত্যিকার অর্থে বর্ণবাদের সমাধান হয়নি আজও। অনেকের মতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন।


  • প্রথমতঃ রাষ্ট্রকে হতে হবে কল্যাণমুখী এবং জনবান্ধব। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রধান লক্ষ্য বিবেচিত না হয়ে, জনগণের মৌলিক ও মানবিক কল্যাণ সাধন হওয়া উচিত সর্ব প্রধান উদ্দেশ্য।


দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রপরিচালনার কারী দলগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে তাদের প্রচলিত মতবাদ। জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচিত করে সমষ্টি উন্নয়ন এবং সেবা প্রদানের জন্য, শাসন করার জন্য নয়। যতদিন পর্যন্ত "শাসনের" স্থানে "সেবা করা" মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা হবে না ততদিন মুক্তির পথ বন্ধ।


তৃতীয়তঃ রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত একমাত্র পথ বলে বিবেচনা করে, অন্যায়কারী ব্যক্তিকে আইনের সম্মুখে হাজির করে প্রভাবহীন বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।


যুগ এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে, জর্জ ফ্রয়েড এবং এরিক গার্নারদের মত অনেকে মৃত্যুবরণ করেন সারাবিশ্বে। দেশভেদে হত্যাযজ্ঞ একেক রূপে হয়। এই পৃথিবীতে মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রতিযোগিতা হয় ঠিকই, তবে মানুষ ভুলে যায় কেবলমাত্র বেঁচে থাকলেই মৌলিক চাহিদার প্রাধান্য আছে।

হয়তো সব কিছুরই নিশ্চয়তা আছে পৃথিবীতে, কেবলমাত্র মানুষের জীবন ছাড়া। কারো স্বার্থহানি হলেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারেন যে কেউই। জীবনের সুরক্ষার প্রত্যাশায় আজকের মত এখানেই বিদায়।   


+লেখক: আসাদুজ্জামান খান জিসান

ইতিহাসনামা.কম এর ৩ জন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। হাইবারনেশনে থাকা ভাল্লুকদের প্রতি অসীম ঈর্ষা রয়েছে তার।

লেখকের ফেসবুক:আইডি লিংক