ওয়াসিম আকরাম বনাম গ্লেন ম্যাকগ্রা - লিখেছেন - আতিক মোর্শেদ
দুইজন ক্রিকেটারের মধ্যে তুলনা করা সবসময় কঠিন। আর ক্রিকেটার দুজন যদি হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুইজন তাহলে সেটা হয় দুঃসহ এক কাজ। তবুও সব ফ্যাক্টর বিবেচনা করে মানুষ একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করে।
পরিসংখ্যান সবসময় সত্য বলে না বটে, তবে পরিসংখ্যান এমন একটা জিনিস যেটাকে আপনি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারবেন না।প্রথমে তাই দু'জনের পরিসংখ্যানের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকঃ
১.ওয়ানডেতে ম্যাকগ্রার ২৫০ ম্যাচে ২২.০২ গড় আর ৩.৮৮ ইকোনমিতে উইকেট ৩৮১টি। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ১৬ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ১.৫২। অন্যদিকে ওয়াসিম ৩৫৬ ম্যাচে ২৩.৫২ গড় আর ৩.৮৯ ইকোনমিতে উইকেট পেয়েছেন ৫০২টি। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ২৩ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ১.৪১।
২. শুধুমাত্র ফাইনাল ম্যাচ হিসেব করলে ম্যাকগ্রার ২৭ ম্যাচে ১৬.৪৩ গড় আর ৩.৯২ ইকোনমিতে উইকেট ৫৫ টি। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ৪ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ২.০৩। অন্যদিকে ওয়াসিম ৩৬ ম্যাচে ২৪.১৮ গড় আর ৩.৭৭ ইকোনমিতে উইকেট পেয়েছেন ৪৯টি। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ১ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ১.৩৬।
৩. জয় পাওয়া ১৭১টি ম্যাচে ম্যাকগ্রা ১৭.৯৪ গড় আর ৩.৬৫ ইকোনমিতে ৩০১টি উইকেট। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ১৫ বার। অন্যদিকে জয় পাওয়া ওয়াসিম ১৯৯টি ম্যাচে ১৮.৮৬ গড় আর ৩.৭০ ইকোনমিতে ৩২৬ উইকেট। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ১৮ বার।
৪.বিশ্বকাপে ম্যাকগ্রার ৩৯ ম্যাচে ১৮.১৯ গড় আর ৩.৯৬ ইকোনমিতে উইকেট ৭১টি। ম্যাচে চারটির বেশি উইকেট পেয়েছেন ২ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ১.৮২। অন্যদিকে, ওয়াসিম ৩৮ ম্যাচে ২৩.৮৩ গড় আর ৪.০৪ ইকোনমিতে উইকেট পেয়েছেন ৫৫টি। ম্যাচে ৪+ উইকেট পেয়েছেন ৩ বার, ম্যাচপ্রতি উইকেট ১.৪৪।
৫. ম্যাকগ্রা ব্যাটিং অর্ডারের টপ থ্রি'র উইকেট পেয়েছেন ১৮১টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ৪৭.৫০%। মিডল অর্ডারের ৪ জনের উইকেট পেয়েছেন ১১৮টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ৩১.০০% এবং লোয়ার থ্রি'র উইকেট পেয়েছেন ৮২টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ২১.৫০%। অন্যদিকে, ওয়াসিম ব্যাটিং অর্ডারের টপ থ্রি'র উইকেট পেয়েছেন ২২৯টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ৪৫.৬০%, মিডল অর্ডারের ৪ জনের উইকেট পেয়েছেন ১৪৬টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ২৯.১০% এবং লোয়ার থ্রি'র উইকেট পেয়েছেন ১২৭টি, যা তার ক্যারিয়ার উইকেটের ২৫.৩০%।
৬. ওয়ানডেতে ম্যাকগ্রা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন ২৫০ ম্যাচে ১৫ বার, অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১৬.৬৬ ম্যাচে ১ বার। অন্যদিকে, ওয়াসিম হয়েছেন ৩৫৬ ম্যাচে ২২ বার, গড়ে প্রতি ১৬.১৮ ম্যাচে ১ বার।
৭. ম্যাকগ্রা ৫৩টি সিরিজ খেলে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছেন ১ বার, ওয়াসিম ৯৩টি সিরিজ খেলে ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছেন ৩ বার।
উপরের পরিসংখ্যানগুলো দেখলে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, অন্তত পরিসংখ্যানে ওয়াসিম কিছুটা হলেও পিছিয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রার চেয়ে। কিন্তু কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে তো আর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না, পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে।
ইনাদের দুজনের তুলনার একটা অবধারিত বিষয় হচ্ছে ওয়াসিমকে বেশিরভাগ সময় বল করতে হয়েছে উপমহাদেশের পিচে, যা কিনা বেশিরভাগ সময়ই স্পিনবান্ধব। অন্যদিকে ম্যাকগ্রা বেশিরভাগ সময়েই বল করেছেন অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলিংবান্ধব পিচে।
প্রথমে উপমহাদেশের বিষয়টা লক্ষ্য করা যাক:
ভারতের মাটিতে পেস বোলারদের জন্য সবচেয়ে বদ্ধভূমি হিসেবে বিবেচিত। সেখানে ২১ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ৩০ উইকেট। গড় ২৮.৬৭, স্ট্রাইক রেট ৩৭.৯৩ আর ইকোনমি ৪.৫৩। ওয়াসিমের সংগ্রহ ১৮ ম্যাচে ২২ উইকেট। গড় ২৯.৮২, স্ট্রাইক রেট ৪৩.৩২ আর ইকোনমি ৪.১৩।
পাকিস্তানের মাটিতে ৮ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার উইকেট ১৫টি; গড় ১৯.৮, স্ট্রাইক রেট ২৮.৯৩ আর ইকোনমি ৪.১১। ওয়াসিমের সংগ্রহ ৬৭ ম্যাচে ৭২ উইকেট; গড় ৩১.১৩, স্ট্রাইক রেট ৪২.৮৫ আর ইকোনমি ৪.৩৬।
শ্রীলংকার মাটিতে ১২ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ২১ উইকেট; গড় ২০.৯৫, স্ট্রাইক রেট ২৮.৮১ আর ইকোনমি ৪.৩৬। ওয়াসিমের সংগ্রহ ১৪ ম্যাচে ২২ উইকেট; গড় ১৬.১৮, স্ট্রাইক রেট ৩০.১৪ আর ইকোনমি ৩.২২।
যেহেতু শারজাহ এবং বাংলাদেশে ম্যাকগ্রা খেলেননি তাই এই দুই দেশের পরিসংখ্যান ওয়াসিমের ক্ষেত্রেও বাদ দেওয়া হয়েছে। যদি শারজাহ এবং বাংলাদেশ বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে ওয়াসিমের সংগ্রহ ১৮৪ ম্যাচে ২৫০ উইকেট, ম্যাচপ্রতি ১.৩৫।
এখন উপমহাদেশের বাইরে পেস বান্ধব এলাকা গুলোতে একটু লক্ষ্য করা যাক:
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৯৬ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ১৬১ উইকেট; গড় ২০.২৩, স্ট্রাইক রেট ৩২.১২ আর ইকোনমি ৩.৭৮। ওয়াসিমের সংগ্রহ ৬৪ ম্যাচে ৮৭ উইকেট; গড় ২৪.৯৭, স্ট্রাইক রেট ৩৯.৪০ আর ইকোনমি ৩.৮০।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ২৭ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার উইকেট ৩৭টি; গড় ২২.০৮, স্ট্রাইক রেট ৩৭.০৮ আর ইকোনমি ৩.৫৭। ওয়াসিমের সংগ্রহ ২৪ ম্যাচে ৪৩ উইকেট; গড় ১৯.৪০, স্ট্রাইক রেট ২৯.৮১ আর ইকোনমি ৩.৯০।
ইংল্যান্ডের মাটিতে ২৭ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ৩৮ উইকেট; গড় ২৩.৭৪, স্ট্রাইক রেট ৩৮.৩২ আর ইকোনমি ৩.৭২। ওয়াসিমের সংগ্রহ ২৩ ম্যাচে ২৮ উইকেট; গড় ৩১.৩২, স্ট্রাইক রেট ২৮.৩৬ আর ইকোনমি ৪.০৫।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ২২ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ৩৬ উইকেট; গড় ২০.৫০, স্ট্রাইক রেট ২৮.৩৬ আর ইকোনমি ৪.৩৪। ওয়াসিমের সংগ্রহ ১২ ম্যাচে ১৪ উইকেট; গড় ৩২.৪৩, স্ট্রাইক রেট ৪৫.৬৪ আর ইকোনমি ৪.২৬।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১৫ ম্যাচ খেলে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ২১ উইকেট; গড় ২৪.৭৬, স্ট্রাইক রেট ৩৫.২৪ আর ইকোনমি ৪.২২। ওয়াসিমের সংগ্রহ ২০ ম্যাচে ৩৭ উইকেট, গড় ১৫.৪৬, স্ট্রাইক রেট ২৭.০৮ আর ইকোনমি ৩.৪৩।
পেস বান্ধব পিচগুলোতে ম্যাকগ্রার সংগ্রহ ১৮৭ ম্যাচে ২৯৩ উইকেট, ম্যাচপ্রতি ১.৫৬। বিপরীতে ওয়াসিমের সংগ্রহ ১৪৩ ম্যাচে ২০৯ উইকেট, ম্যাচ প্রতি ১.৪৬।
সমসাময়িক ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে সফলতায়ঃ
শচীন টেন্ডুলকারকে ওয়াসিম আউট করেছেন ২৪ ম্যাচে ৩ বার, আর ম্যাকগ্রা করেছেন ২৩ ম্যাচে ৭ বার। ব্রায়ান লারাকে ওয়াসিম আউট করেছেন ৩৩ ম্যাচে ৭ বার এবং ম্যাকগ্রা করেছেন ২৯ ম্যাচে ৩ বার।
সৌরভ গাঙ্গুলীকে ওয়াসিম আউট করেছেন ১৭ ম্যাচে ৫ বার,আর ম্যাকগ্রা করেছেন ১৬ ম্যাচে ৫ বার।
দলীয় সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ম্যাকগ্রা এগিয়ে ছিলেন ওয়াসিমের চেয়ে। ম্যাকগ্রা খেলেছিলেন একটা অসাধারণ অস্ট্রেলিয়া দলে। সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের অনেকেই অস্ট্রেলিয়া দলে থাকায় ম্যাকগ্রাকে অল্প রান ডিফেন্ড করতে হয়েছে খুব অল্প সময়েই। অন্যদিকে ওয়াসিমের পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন সবসময়ই ভঙ্গুর ছিল। দুই একজন স্পেশাল ব্যাটসম্যান থাকলেও ওভারঅল লাইনআপ বাজেই ছিল বলতে হয়। ওয়াসিমকে বেশিরভাগ সময়েই এমন পরিস্থিতিতে বোলিং করতে হয়েছে, যেখানে সে ম্যাকগ্রার চেয়ে সুবিধাজনক পজিশনে কমই ছিলেন। ২৫০+ স্কোর ডিফেন্ড করার চেয়ে ২০০+ স্কোর ডিফেন্ড করা অবশ্যই কঠিন।
আর একটা ফ্যাক্টর হচ্ছে ফিল্ডিং। ফিল্ডিংয়ে অস্ট্রেলিয়া দল তখন বিশ্বের সেরা দলগুলোর মাঝে একটা, আর পাকিস্তান সবচেয়ে বাজে দল গুলোর মাঝে একটা। ওয়াসিমের বলে যে কতগুলো ক্যাচ মিস হয়েছে সেটার হিসেবই নেই।
এবার দেখা যাক, ফ্যাক্টরগুলো বাদ দিলে কেবল স্কিলের দিকে কে এগিয়ে?
অন্তত ৫০ কিংবা তার চেয়ে বেশী রান করেছেন এমন ব্যাটসম্যানকে ওয়াসিম আউট করেছেন ৪৩ বার, প্রতি ৮.২৭ ইনিংসে তিনি একবার এই কাজটি করতে পেরেছেন। অন্যদিকে ম্যাকগ্রা এমন ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পেরেছেন মাত্র ২১ বার, প্রতি ১১.৯০ ইনিংসে তিনি একবার ৫০+ রান করা ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন।
ম্যাচে ৫০+ রানের জুটি ওয়াসিম ভাঙতে পেরেছেন ৪৮ বার, অন্যদিকে ম্যাকগ্রা ভাঙ্গতে পেরেছেন ৩১ বার।
ওয়াসিম আকরাম খেলেছেন এমন ম্যাচে সেঞ্চুরি হয়েছে ৩০টি। এর মাঝে ৭ বার তিনি সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পেরেছেন, শতকরা হিসেবে যেটা দাঁড়ায় ২৩.৩৩। ম্যাকগ্রা খেলেছেন এমন ম্যাচে সেঞ্চুরি হয়েছে ২২টি, সেঞ্চুরী করা ব্যাটসম্যানকে আউট করতে পেরেছেন ৩ বার, শতকরা হিসেবে যেটা দাঁড়ায় ১৩.৬৩ এ।
অতঃপর গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং ওয়াসিম আকরাম – দু'জনেই গ্রেট বোলার,এদের দুজনের মধ্যকার তুলনা করা অসম্ভব ব্যাপার।এখন আপনার ব্যাপার আপনার সেরা দলে আপনি কাকে রাখবেন?
তথ্যসূত্রঃHowstat,RoarBangla,ESPNCricinfo