পর্যালোচনা: দেশে বিদেশে+সৈয়দ মুজতবা আলী - লিখেছেন - আশেকুল মোস্তফা আবরার
দেশে বিদেশে এক বাঙালি যুবকের বিশ্বভ্রমণের গল্প। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে পূর্ব বাংলার এক বাঙালি মুসলিম যুবক মূলত জ্ঞান সাধনার জন্যে বাড়ি ছেড়ে বের হয়। তার ভ্রমণকালীন বিভিন্ন ঘটনাবলী, যাত্রাপথের সঙ্গী, ভ্রমণকৃত স্থানসমূহ এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার হাস্যরসাত্মক বর্ণনার মাধ্যমে গল্পটি এগিয়েছে।
যাত্রা শুরু হয় কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে।যাত্রার শুরুতেই লেখক ইউরোপিয়ান থার্ডে উঠতে চাইলে এক ফিরিঙ্গি তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেয় "এটা ইউরোপিয়ানদের জন্য"। এই একবাক্যের মধ্য দিয়ে শতবর্ষ ধরে ভারতবর্ষ শাসন করা ইংরেজদের অহম আর ভারতবাসীর প্রতি তাচ্ছিল্যতা সহজেই প্রকাশ পেয়ে উঠে। আর লেখকও যখন বন্ধুত্বপূর্ণভাবে পাল্টা যুক্তি দেন তখন ফিরিঙ্গি ঠিকই লেখককে গাড়িতে তুলে নেয়। লেখকের মূল গন্তব্য ছিলো পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান। পেশোয়ার স্টেশনে নেমে এক পাঠানের সাথে লেখক সপ্তাহখানেক পাকিস্তান অবস্থান করেন। এই ক'দিনের আড্ডাবাজিতেই লেখক পাঠানদের আড্ডাপ্রিয়তা, দেশপ্রেম, অতিথি আপ্যায়নতা তুলে ধরেন।কয়েক লাইনের বর্ণনাতেই পাঠক পাঠানদের বেশ ভালোভাবেই চিনে নিতে পারবেন। তারপর খাইবারপাস দিয়ে আফগানিস্তান যাত্রাপথে বাসের সরদারজী আর কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে রসাত্মক আলাপচারিতায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
লেখক মূলত আফগানিস্তান যান তৎকালীন আফগান সরকারের আমন্ত্রণে কাবুলে কৃষিবিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করতে। কাবুলে ওঠেই লেখক বাড়ির সাথে ভৃত্য হিসেবে পেয়ে যান আবদুর রহমান কে। এই বইয়ে আবদুর রহমান বিরাট ছাপ রেখেছে। লেখকের সাথে আবদুর রহমানের হাস্য-রসাত্মক আলাপ আলোচনা পাঠকের ভীষণ সুখপাঠ্য হবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। লেখক আবদুর রহমানের পরিবেশন করা খাবারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- "ডাবর নয়,ছোটোখাটো একটা গামলা ভর্তি মাংসের কোরমা বা পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্কাথে সেরখানেক দুম্বার মাংস- তার মাঝে মাঝে কিছু বাদাম কিশমিশ লুকোচুরি খেলছে, এক কোণে একটি আলু অপাঙক্তেয় হওয়ার দুঃখে ডুবে মরার চেষ্টা করছে। আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক ফুল বোম্বাই সাইজের শামিকাবাব। বারকোশ পরিমাণ থালায় এক ঝুড়ি কোফতা-পোলাও আর তার ওপর বসে আছে একটি আস্ত মুরগি-রোস্ট।
আমাকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবদুর রহমান তাড়াতাড়ি এগিয়ে অভয়বাণী দিল- রান্নাঘরে আরও আছে।"
এই অংশটি পড়েই পাঠক কল্পনা করে নিতে পারেন লেখক কতোটা রসাত্মকভাবে বইটি লিখেছেন। সাথে আফগানদের ভোজনপ্রিয়তাও এই কয় লাইনে সহজেই জেনে যাওয়া যায়। এখানেই লেখক সৈয়দ সাহেবের মুন্সিয়ানা! মিশুক স্বভাবের লেখকের কাবুলে গিয়ে বন্ধু বানিয়ে আড্ডা জমাতে দেরি হয় নি। অধ্যাপক, দূতাবাসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কাবুলের কৃষক এমনকি স্বয়ং আফগান রাজপুত্রও হয়ে গিয়েছিলেন লেখকের প্রাণের দোস্ত!তারপর লেখকের প্রাত্যহিক জীবন যাপনের বর্ণনায় কাবুলের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি-সাহিত্য বেশ ভালোভাবেই চিত্রিত হয়ে ওঠে। ফরাসি জানা লেখকের একইসাথে রুশ শেখার জন্য মোটা ডিকশনারি পড়া, তার ওপর জার্মানি গিয়ে পড়ার জন্য শিক্ষাবৃত্তির আবেদন; তৎকালীন সময়ে এক বাঙালি যুবকের এই তীব্র জ্ঞানানুরাগ পাঠককে সত্যিই অনুপ্রাণিত করবে।
শেষ দিকে লেখক আফগানিস্তনের রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও কিছুটা আলোকপাত করেন। লেখক যখন আফগানিস্তান ত্যাগ করেন তখন তার ভৃত্য আবদুর রহমানকে নিয়ে লেখা "বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়।" অংশটি আপনার চোখে পানি এনে দেবে। হাস্যরসিক লেখকের এই আবেগ পাঠককেও গভীরভাবে ছুঁয়ে দেবে।
এতো উৎকৃষ্ট ভ্রমণকাহিনী বাংলা সাহিত্যে এখনো দ্বিতীয়টি লেখা হয় নি। মাধ্যমিকের প্রতিটি ক্লাসের বাংলা বইয়ে এই ভ্রমণ কাহিনী থেকে অবশ্যপাঠ্য একটা না একটা অনুচ্ছেদ দেওয়া হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি এতো সুখপাঠ্যভাবে কোনো লেখক বর্ণনা করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। ভীষণ সুখপাঠ্য এই বইটি উপভোগ করতে চাইলে সময় হলেই পড়ে নিতে পারেন।