ভোর ছয়টা নাগাদ বাসা থেকে বের হলাম একটু পায়চারি করতে। রাস্তায় নেমেই দেখি গাছগুলি আমার দিকে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি তা উপেক্ষা করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সকালের শীতল হাওয়া যা কিছুটা স্বস্তি দিলেও খানিক পর তা কেড়ে নেয় পাখির কিচিরমিচির ডাক। মনে হচ্ছে কানের উপর তবলা বাজাচ্ছে। লোকে আমাকে বলবে পাগলের মত একি বলছি? সকালে পাখির কিচিরমিচির ডাক কি কারো স্বস্তি কেড়ে নেয়? আসলে পাখির ডাক কখনো বিরক্তির কারণ হতে পারে না। বিরক্তি বা ভালোলাগা সবকিছুই তার মনের উপর নির্ভর করে। মন ভালো থাকলে সব ভালো মন খারাপ থাকলে সব খারাপ। কিন্তু মনটা যে কেন খারাপ তাই বুঝতে পারছি না। তাই কারণটা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। ঠিক সেই সময় টুকটুক করে হাঁটার শব্দ কানে ভেসে এলো। হাঁটার শব্দ শুনে বুঝতে পেলাম নিশ্চয়ই কোন এক যুবতী মেয়ে আসছে। যুবতী মেয়েদের হাঁটার মধ্যে আলাদা একটা ছন্দ লুকায়িত থাকে। সে ছন্দ কিন্তু সবাই বুঝতে পারে না শুধু বিশেষ গুণ সম্পন্ন কিছু যুবক ই তা বুঝতে পারে। আমিও হয়তোবা সেই বিশেষ গুণ সম্পন্ন এক যুবক যার কারণে ছন্দটা বুঝতে পারছি। তাই পিছন দিকে ফিরে মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আসলে সব ছেলেই মেয়েদের ব্যাপারে একটু বেশি কৌতুহল তাই আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘাড়টা বাকিয়ে আড়চোখে তাকালাম, তাকিয়ে সাথেসাথে ঘাড়টা সোজা করে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আর মনে মনে বললাম এই কারণেই হাটের ছন্দটা একটু বেশি পরিচিত মনে হচ্ছিল। যতটুকু মন খারাপ ছিল তা এখন ভালো হয়ে গেছে। এখন আর গাছ উঁকি মারছে না, পাখির কিচিরমিচির বিরক্তি লাগছে না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি মারছে। এত সকালে সায়মা যাচ্ছেটা কোথায়? কাঁধে বোধহয় একটা ব্যাগ ছিল কিন্তু ক্ষানিক পর আবার মনে হিচ্ছিল ছিলনা। কিন্তু কথা হলো, যাচ্ছেটা কোথায়? মনের মধ্যে এই জানতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। সত্যি কথা বলতে কি, জানতে চাওয়াটা বিষয় না। আসলে ওর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। ওর কন্ঠস্বরটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও ভেতর থেকে বাধা দিচ্ছে। কারণ একটা জুনিয়র মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা একটু বেমানান দেখায়। তাই কিছু বলতে পারছিনা। ভেতরে একটা তীব্র জ্বালা নিয়ে ওর সামনে হাঁটছি। হাঁটার সময় ওর গতিবেগ এর সাথে মিল রেখেই হাঁটছি, যাতে বাতাসে ভেসে আসা ওর গন্ধ টা হারিয়ে না ফেলি। এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কিছুটা পথ অতিক্রম করেছি। এরই মধ্যে মিষ্টি একটা গলা শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি সায়মা আমার পাশেই হাঁটছে। আর বলল,


-হাসান ভাইয়া, এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন?


যেটা এতক্ষন ধরে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম, সেটা শোনার পর মনের মধ্যে তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললাম,



-আসলে কি জানো সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কেমন জানি মনটা খারাপ ছিল। তাই বাইরে বের হলাম। একটু হাটাহাটি করছি আরকি।


-আচ্ছা এখন আপনার মন ভালো হয়েছে?


- উমমম...হ্যাঁ, একটু আগেই ভালো হয়ে গেছে।


-একটু আগে ভালো হয়ে গেছে মানে?


ওর এই মানে কথাটার উত্তর কি দেব সত্য বলা যাবে না যে........


-কী ভাবছেন এত? একটু আগে মন ভালো হয়ে যাওয়ার কারন টা কি?


ওকে তো আর বলা যাবে না যে মন ভালো হওয়ার কারণটা হলো তুমি। তাই কিছুতো ওকে গোজামিল দিতে হবে।


-মানে এতক্ষণ ধরে তো বাতস বইছিলনা। পরিবেশটা কেমন জানে ছিল। কিন্তু এখন হালকা বাতাস বইছে তাই ভালো লাগছে।


-হইছে। গুল মাইরেন না।


-গুল!! কেন, বিশ্বস হয়নি আমার কথা?


-না।


বলেই সায়মা মুচকি একটা হাসি দিল। খুব মিষ্টি লাগছে ওকে। কিন্তু ওর মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। তা যাই হোক আমি আর কথা বললাম না জানি এই বিষয়টা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে আমার কোন লাভ শুধুই লস। দুজনে নীরবে কতক্ষন হাঁটলাম কেউ কোন কথা বলছি না কিন্তু আমি সে নীরবতা ভঙ্গ করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,


-এত সকালে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?


-সুদীপ স্যারের কাছে যাচ্ছি রসায়ন পড়তে।


-এত সকালে ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট লাগে না?


-অবশ্যই। কিন্তু কি আর করার স্যারের শুধু এই সময়টায় ফাঁকা ছিল। তাই কষ্ট হলেও যেতে হয়। আবার এত সকালে কোন রিক্সাও পাওয়া যায় না। তাই কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। হেঁটে হেঁটে যেতে হয় তা আবার একা একা। ধুর.. এসব ভালো লাগেনা আর।


-ও আচ্ছা। তুমি চাইলে আজকে তোমার সঙ্গ দিতে পারি।


-না থাক লাগবে না। আমার একা যাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। আর আজ আপনি সঙ্গ দিলে যদি আমার কাছে তা ভালো লাগে যায় তাহলে পরবর্তীতে একা যেতে কষ্ট লাগবে। আমি চললাম। আপনার আসা লাগবে না।


একটু শান্ত গলায় বললাম,


-যদি প্রতিদিন সঙ্গ দেই?


-আপনি পারবেন না। আপনি ঘুম পাগল।


-আচ্ছা আমি যে ঘুম পাগল তা তুমি জানলে কিভাবে?


সায়মা খুব শান্তভাবে বললো,


-না,তা বলবো না।


-কেন?


-এমনি।


বলেই মুচকি হাসি দিল কিন্তু এবার ওর হাসিতে পাগল হলাম না। অনেকক্ষণ বলাবলির পর বলল আমার ভাই নাকি তাকে বলেছেন। কিন্তু আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছে। তা না হলে ও তো কিছু বলার মত ছেলেনা। তা যাই হোক আরো শত রকমের কথা কথা বলতে বলতে কখন যে স্যারের বাসার প্রায় কাছেই চলে এসেছি তা বুঝতে পারিনি, মনে হয় সাইমাও বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মনের মধ্যে অনন্য এক অনুভূতির সৃষ্টি হল। মনে হচ্ছে একটুকরা মেঘ আমাকে ছুঁয়ে গেল। আসলে দুজনে এতটাই কাছাকাছি হাঁটছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন ওর হাতের স্পর্শ লেগে গেল। ওর দিকে তাকাতেই আবার সেই পাগল করা মুচকি হাসি।

স্যারের বাসার সামনে আসতেই সে বলল,


-একদিন না পড়লে স্যার কিছু বলবে না। চলেন একটু সামনের দিকে যাই।


বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,


-আচ্ছা,চলো।


-দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলেন....


বলেই হাত ধরে টান দিল। আমিও চললাম


এবার আত্মবিশ্বাসের সহিত সায়মা কে জিজ্ঞেস করলাম,


-তাহলে কালকে সকাল 5:45 এ অপেক্ষা করব?


-আপনার যা মন চায় তাই কইরেন। এখন চলেন।


পথটা বোধহয় শেষ হবার নয়। এত সুন্দর আগে কখনো দেখিনি। ও আমার হাতটা এখনো ধরে আছে আর কি যেন বকবক করে বলে যাচ্ছে। আমি বোঝার চেষ্টাও করছি না শুধু শুনে যাচ্ছি।    


+ লেখক: অনিক মাহমুদ

আমি অনিক মাহমুদ। ইচ্ছা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া। এর পাশাপাশি ইচ্ছা পাখির কুজনে ভরা কোন এক অরন্যের মধ্যে একটা বাগানবাড়ি করার। যেখানে সারাদিন বইপড়লেও যাতে কেউ বিরক্ত না করে আর তার সাথে নিজের পছন্দের কিছু পাখি পালন।

ফেসবুক লিংক:আইডি লিংক