চল্লিশ বনাম এক: একজন গোর্খা কর্পোরালের বীরত্বগাথা
সেপ্টেম্বর, ২০১০ এর মধ্যরাত। ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে উত্তর প্রদেশগামী মাউরিয়া এক্সপ্রেস, পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল ভেদ করে এগিয়ে চলেছে। ট্রেন ভর্তি যাত্রীদের অনেকেই তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। যাত্রীবাহী ট্রেনটি আসানসোল চিত্তরঞ্জন শহরতলীর ঘন জঙ্গলে প্রবেশের খানিক পরেই গতি কমাতে বাধ্য হয়। ততক্ষণে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙ্গে আনুমানিক চল্লিশজন সশস্ত্র ডাকাত চারদিক থেকে ট্রেনটিতে ছুটে আসছে। প্রতেক্যের হাতে ধারালো অস্ত্র, লাঠি অথবা পিস্তল। ডাকাতদের হইচইয়ে ঘুম ভেঙে যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত একজন চৌকস গোর্খা সৈনিকের। দৈবক্রমে যিনি সেদিন নেপাল যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাউরিয়া এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করছিলেন।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিয়তিকে মেনে নিয়ে ডাকাতদের হাতে সর্বস্ব তুলে দিতে থাকেন ট্রেনের যাত্রীরা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম গোর্খা রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরালটিও সিদ্ধান্ত নিলেন আত্নসমর্পনের। কারণ মধ্যরাতে ডাকাত আক্রান্ত একটি থেমে থাকা ট্রেনে একাকী বিদ্রোহ করার ভয়াবহ পরিণতি তিনি জানেন। এখানে কেউ তাকে চেনে না। তার হুঙ্কারে নিরীহ যাত্রীদের কেউই ডাকাতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না। তাছাড়া, ডাকাতরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ গুম করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাই নির্বিবাদে তিনি তার সাথে থাকা টাকা পয়সা ডাকাতদের দিয়ে দিলেন। নেপালি চেহারার একজন সুঠামদেহী মানুষের ব্যাগে যে কুকরির মতো একটা ভয়াবহ ছুরি থাকতে পারে সেটা হয়তো ডাকাতরা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরাল সাহেবের পাশের সিটেই স্বপরিবারে সহযাত্রী হয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সী একজন নারী। ডাকাতদের একজন নারীটিকে গণধর্ষনের অভিপ্রায়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনার এই পর্যায়ে প্রতিটি গোর্খাকে শিক্ষা দেয়া নীতিবাক্য মনে পড়ে যায় ৩৫ বছর বয়সী কর্পোরালের। ''Kaphar hunnu bhanda marnu ramro'' অর্থাৎ ''কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়''। কর্পোরালের ব্যাগ থেকে তড়িৎগতিতে বের হয়ে যায় প্রতিটি গোর্খার সার্বক্ষণিক বন্ধু; কুকরি। শুরু হয় চল্লিশ বনাম একের মরণযুদ্ধ।
নারীটির গায়ে হাত দেয়া ডাকাতটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারাত্নক ভাবে আহত হয়ে পড়ে। তাকে ঢালের মতো ব্যবহার করে মাত্র একটি কুকরিকে সম্বল করে চলতে থাকে কর্পোরালের হাতাহাতি যুদ্ধ। কিন্তু গোর্খাদের সাথে হাতাহাতির পরিণাম কি হয় সেটা দুই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসেই লেখা আছে। যাত্রীভর্তি ট্রেনের মধ্যে কর্পোরালকে নিশানা করে ছোড়া একটি গুলিটি মিস হয়। ডাকাতেরা কর্পোরালকে খুন করতে বেপোরোয়া হয়ে গেছে, কেননা এর মধ্যেই তিন জন ডাকাতকে হত্যা এবং আটজনকে গুরুতর আহত করে ফেলেছেন কর্পোরাল। এই ভয়াবহ ঘটনার এক পর্যায়ে ডাকাতদের আঘাতে কর্পোরালের হাত থেকে কুকরিটি মেঝেতে পড়ে যায়। ডাকাতেরা সেই কুকরিটি দিয়েই কর্পোরালের বাম হাতে গুরুতর জখম করে ফেলে। তবে ততক্ষণে কর্পোরালের সাহসিকতায় ট্রেনে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ যাত্রীদের পাল্টা আক্রমণে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় বাকি ডাকাতেরা। পরের স্টেশনে থেমেই আহত কর্পোরালকে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটস্থ হাসপাতালে। পরবর্তীতে ভারতীয় পুলিশ, ট্রেন ডাকাতদের চক্রটিকে গ্রেফতার করে বিপুল অর্থ এবং স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করে।
এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনাটি ২০১০ সালে উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা। সেসময় সারা পৃথিবীতে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় সিক্ত হন এই গোর্খা বীর, কর্পোরাল বিষ্ণু শ্রেষ্ঠা। বীরত্বের প্রতিদানস্বরূপ ভারতীয় সেনাবাহিনীর "সেনা মেডেল" এবং ভারত সরকারের "উত্তম জীবন রক্ষা পদক" মেডেলে ভূষিত হন অবসরপ্রাপ্ত এই কর্পোরাল।
কর্পোরাল বিষ্ণু শ্রেষ্ঠাকে সেই মেয়েটির জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মেয়েটির পরিবার মোটা অংকের অর্থ উপহার দিতে চেয়েছিলো। তিনি সেই উপহার আন্তরিকতার সাথে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,"সৈনিক হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো রণাঙ্গনে শত্রুদের সাথে লড়াই করা, আর মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য ছিলো ডাকাতদের সাথে লড়াই করা"।