লেপচা জনগোষ্ঠী

উপমহাদেশের অন্যতম পরিচিত কিন্তু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলো লেপচা যারা মূলত লেপাল, দার্জিলিং, সিকিম, ভুটান অঞ্চলের পার্বত্য জনগোষ্ঠী। লেপচা লোকগাথায় জানা যায় তাদের আদি ধর্মগুরু ছিলেন They kung Tek ও গুরুপত্নী ছিলেন Nikung Yangal. সে সময় ধর্মগুরুই রাজা ছিলেন। তাই বলা যায় যে ইনিই প্রথম লেপচাদের রাজা ছিলেন। জাতিগত ও উপজাতিগত কৌলিন্যের দাবী আজ অনেক জাতি ও উপজাতির মধ্যে সোচ্চার হয়ে উঠেছে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তাদের অধিকাংশের দাবী নাকচ হচ্ছে ও হবে কিন্তু লেপচা উপজাতি যথার্থই বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের অধিকারী হয়েও লেপচা উপজাতি গবেষকদের হাতে বেশ কিছু মৌলিক সম্পদ তুলে দিতে পারে।

লেপচাদের প্রতিটি পালাপার্বন ও উৎসব আয়োজনের পশ্চাতে হাজার হাজার বছরের পুরনো কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে। এরা যে পালাপার্বন ও উৎসব আয়োজনে বছরের পর বছর ধরে পালন করে আসছে তার মধ্যে রয়েছে আপন বৈশিষ্ট্যের প্রবাহ। তাইতো পৃথিবীর এক কোণে থেকেও এরা আজো গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে আসছে।
 

মানচিত্রে সিকিম

লেপচাদের আদি বাসভূমি সিকিম। প্রাচীন সিকিমের প্রকৃত সীমানা সঠিকভাবে এখনো নির্ধারন করা যায়নি। তবে একটুকু প্রমানিত যে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, তরাই অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাই সিকিমের অন্তর্গত ছিলো। লেপচাদের আদি বাসস্থান সিকিমের তিনটি লেপচা নামের সন্ধান পাওয়া যায় তা হলো ন্যে -মো এল, রিং -জোং, আরোং -ল্যাং। লেপচারা নিজেদের পরিচয় দেয় মুতনচী-রোঙ। সিকিমে এরা অবশ্য মুন্দ্রী নামে পরিচিত। লেপচা বা লাপচে শব্দটি নেপালি লাপচে নামের এক প্রকার অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির মাছের নাম থেকে এসেছে। মূলত লেপচারা অত্যন্ত নিরীহ জাতি বিধায় নেপালিরা তাদের এ নাম দিয়েছে। বর্তমান সিকিম ছাড়াও নেপাল, দার্জিলিং, ভুটানে লেপচাদের নিয়মিত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এসব এলাকায় যে সব লেপচাদের চোখে পড়ে তারা অধিকাংশই নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। মূল লেপচারা আদি কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে আছে বনজংগল ও পাহাড়ে। তারা প্রধানত আধুনিক ডাক্তারদের কাছে যায় না। তাদের সমাজে নিজস্ব কবিরাজ আছে। এরা কুকুর কামড়ানো বা সাপে কাটার মতো দুরারোগ্য রোগ সারাতে পারেন পরে দাবি করেন। তবে তাদের এই জ্ঞান তারা নিজের পরিবারের বাইরে কাউকে শেখান না।
   


 একজন লেপচা পুরুষ
 
লেপচাদের সাথে মংগোলীয়দের আকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়াও নাগাদের সাথেও তাদের অত্যন্ত বেশি পরিমাণে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। লেপচাদের ডিম্বাকৃতি মুখ, বলিষ্ঠ কাঁধ মনে করিয়ে দেয় রোমান ও গ্রীসিয়দের কথা। নৃতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এই সাদৃশ্যের কথা মোটামুটি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন কারন লেপচাদের পোষাক পরিচ্ছেদের সাথেও গ্রীক ও রোমানদের বেশ মিল রয়েছে। লেপচাদের আকৃতিগত অনুসন্ধানে জানা যায় শতদ্রু নদীর তীরে Hangarang নামক জায়গায় ও লাদাকে বসবাসকারী উপজাতিদের সাথে তাদের মিল প্রচুর। কেউ কেউ লেপচাদের তাতার বংশজাত বলে দাবী করেন। যদিও এর তেমন কোন জোরালো ভিত্তি পাওয়া যায় নি। প্রাচীন রোম বা গ্রীসে এবং পারস্য দেশেও প্রস্তর ও অগ্নিপূজার চল ছিলো। লেপচাদের মধ্যেও প্রস্তর ও অগ্নিপূজার চল রয়েছে। বিশেষত কাঞ্চনজংঘার প্রতীক হিসেবে এরা ছোটবড় পাথরের স্তূপ তৈরি করে পূজা করে। লেপচারা নিজেদের কাঞ্চনজংঘার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি পছন্দ করে। মার্চ এপ্রিল মাসে তারা কাঞ্চনজংঘার পূজা করে। তাদের বিশ্বাস কাঞ্চনজংঘার দুটি শৃংঘ থেকে প্রথম দুজন মানব মানবীর জন্ম হয়েছিলো।
 
এছাড়াও লেপচাদের খেলাধুলার মধ্যে তীরধনুক চালনার খেলা খুব জনপ্রিয়। অপরদিকে গ্রীসিয়দের মধ্যেও তীরধনুকের জনপ্রিয়তার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ থেকে স্বাভাবিকভাবে এটা মনে করা যেতে পারেই যে হয়তো অতীতে কখনো লেপচা উপজাতিদের সাথে গ্রীসিয় বা পারস্য সভ্যতার যোগাযোগ ঘটে। তিব্বতীয়রা লেপচাদের মন নামে সম্বোধন করে। মন শব্দের অর্থ পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দা। যদিও ব্রহ্মদেশের প্রগু প্রদেশে মন নামে এক উপজাতি রয়েছে যাদের সাথে লেপচাদের মিল প্রচুর। তবে সব মিলিয়ে লেপচারা সিকিমের আদি অধিবাসী তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা সিকিমকে বলে Ne Manjel Ronjyong Lyang অর্থ্যাৎ পবিত্রভূমি। তবে কালে কালে এদের সাথে ম্ংগোলীয়, ভুটিয়া, নাগা উপজাতির প্রচুর মিশ্রন ঘটেছে।
 
রঙ্গিন ডোরাকাটা পোষাক পরিধান করে লেপচা পুরুষেরা। কোমরে ঝোলানো থেকে বাঁকা লোহার অস্ত্র যাকে বলে Bompok. তারা হাঁটু পর্যন্ত ঢোলা আলখেল্লা পরে। মাথায় থাকে পশমী কাপড়ের তৈরী টুপি। আর লেপচা মেয়েরা ঢিলা জাতীয় পোষাক পরে।
 

লেপচাদের ঘর

লেপচাদের গৃহনির্মান পদ্ধতি বিচিত্র ধরনের। কাঠ ও বাঁশের সাহায্যে এরা গৃহনির্মান করে থাকে। তবে এগুলো এমনভাবে খাঁজ কেটে জোড়া দেয়া হয় যে তাতে পেরেকের কোন প্রয়োজন হয় না। কালিম্পং এর নাস্যে গ্রানে এদের তৈরি অনেকগুলো ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এদের নিজস্ব বাড়ির নাম লি। এটা এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। অধিকাংশ লেপচারা কৃষিজীবী। তবে তারা নেপালি বা ভুটিয়াদের অপেক্ষা অনেক কম পরিশ্রমী। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে তারা প্রচুর পরিমাণে চা বাগানে কাজ নিলেও পরে নেপালিদের সাথে পেরে ওঠেনি। এছাড়া সহজ সরল প্রকৃতির লেপচারা সামান্য টাকার বিনিমইয়ে তাদের জমির স্বত্ব পরিত্যাগ করে। যার ফলে সিকিমে এক সময় সবচেয়ে বেশি জমির মালিক লেপচারা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ে। পশুপালনের মধ্যে লেপচারা ভেড়া পালন করে।
জেনারেল মেইনওয়ারীং বলেন- লেপচা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ভাষা। লেপচা লিপি Indo Burmese লিপিগোষ্ঠীর অন্তর্গত। লেপচা পৌরাণিক উপকথায় জানা যায় লেপচা লিপির উৎপত্তি হয় পাঁচজন লেপচা পন্ডিতের দ্বারা। তারা হলেন তারগে, সায়্যুন, গোলে, তংরাব, দুরীং।

এদের সৃষ্ট লিপিসমূহের এক একটির একাধিক অর্থ রয়েছে। উচ্চারন বিধিও স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক নয়। এছাড়াও সিকিমের তৃতীয় শাসনকর্তা ছাগদোর নামগ্যাল লেপচা লিপির উদ্ভাবক। পরবর্তীতে তিব্বতীয় ভাষা থেকে বৌদ্ধধর্মীয় যে পুস্তক অনূদিত হয় তা সব ছাগদোর সৃষ্ট বর্নমালাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ছাগদোর সৃষ্ট লেপচা লিপির প্রচলনের আগে লেপচাদের যে আদি লিপি ছিল তা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়। এমন প্রমান পাওয়া যায় যে ছাগদোর সৃষ্ট বর্নমালার পূর্বে লেপচা ভাষায় জ্ঞানগর্ভ পুস্তক লেখা হয়েছিলো।


লেপচা ভাষা

এমন এক সময় ছিলো যখন সিকিমের রাষ্ট্রভাষা ছিল লেপচা ভাষা। বিভিন্ন দলিল মারফত জানা যায় উনবিংশ সতাব্দীতেও নেপালে লেপচা ভাষার যোগ্য মর্যাদা ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সর্বস্তরে নেপালি ভাষা পঠনের জন্য লেপচা ভাষার আর কোন বিকাশ ঘটেনি। বর্তমানে প্রায় ৯০% নেপালি লেপচা তাদের মাতৃভাষা জানেই না। জেনারেল মেইনওয়ারীং একজন লেপচা রমণীকে বিয়েও করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন লেপচা সমাজে বসবাস ও করেছেন।  

বহু সমাজবিজ্ঞানী লেপচা সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক বলেছেন। কিন্তু বর্তমানে লেপচা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, যদিও লেপচা সমাজকে নারীকে যথেষ্ঠ প্রাধান্য দেয়া হয়। তারা যদিও যাযাবরের ন্যায় জীবনযাপন করে তথাপি তারা একান্নবর্তী পরিবারে বাস করতে পছন্দ করে। এদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রায় নেই বললেই চলে। পূর্বে পিতৃব্যের মৃত্যুর পর কাকীকে বিয়ে করা যেত অথবা বড় ভাই মারা গেলে বৌদিকেও বিয়ে করা যেত। তবে বর্তমান লেপচারা পুরুষেরা এতে খুব একটা আগ্রহী হন না।  

বৌদ্ধ লেপচারা ও খ্রিস্টান লেপচারা তাদের ধর্মীয় রীতি অনুসারে সৎকার করলেও লেপচাদের নিজস্ব মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি রয়েছে। পুরুষ লেপচার মৃতদেহের সাথে তীর ও ধনুক ও স্ত্রী লেপচার সাথে কাস্তে ও চিরুণী দেয়া হয়। তারা মূলত মৃতদেহকে সমাধিস্থ করে।  তারা কোক অর্থ্যাৎ গোলাকার গহবরে মৃতদেহকে বসিয়ে আবার কোন দেন বা চতুর্ভুজ আকারে গর্ত করে এবং কোক ব্লী বা ত্রিভুজ আকারে গর্ত করে এই তিনভাবে সমাহিত করে থাকে। মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করে তারা সমাধির উপর বৌদ্ধধর্মীয় স্তোত্রাধি একটি কাপড়ে লিখে ঝুলিয়ে রাখে। সিকিম, ভুটান, নেপাল, দার্জিলিং এর গ্রাম গ্রামান্তরে এ ধরনের বহু স্তোত্রাদি লিখিত পতাকা দেখা যায়।
 
লেপচারা মোট তিনটি ধর্মীয় সমাজে বিভক্ত। মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী, তিন চতুর্থাংশ বৌদ্ধ এবং বাকিরা খ্রিস্টান। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনার জন্য যে পুরোহিতের প্রয়োজন তাকে বলা হইয় বঙ থিং। এরা পর্বতকে আদি দেবতাজ্ঞানে আরাধনা করে। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম নামথর। বৌদ্ধধর্মীয় লেপচারা বৈশাখী পূর্নিমায় ভগবান বুদ্ধের আরাধনা করে থাকে। তারা একে চেচু বলে। এছাড়াও লেপচা ও ভুটিয়ারা লোশার নামে নববর্ষ উৎসব পালন করে।
 
অনন্য সৌন্দর্যের সিকিম

লেপচারা স্বভাবতই সৌন্দর্যের পূজারী। লেপচা নারী ও পুরুষ উভয়ই তাঁতে বোনা রং বেরং এর কাপড় তৈরি করে থাকেন। লেপচাদের কাপড়ের সাথে পাকিস্থানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতিদের পোষাকের প্রায় শতভাগ মিল দেখা যায়। লেপচা নারীরা রুপার অলংকার বেশি পড়েন। প্রবাল ও অন্যান্য ধাতুর মালাও তারা পড়েন। লেপচা শিল্পীদের চিত্রাংকনের হাতও ভালো। ঘুম গোম্ফা ও গ্যাংটক রাজকীয় গোম্ফায় লেপচা শিল্পীদের আঁকা চিত্র দেখা যায়।

লেপচারা তো স্বভাবগতভাবেই ঝামেলা এড়িয়ে চলে। আধুনিক সভ্যতা নিয়েও তাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। এরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল। নিজেদের দারিদ্র্যতা সত্ত্বেও অতিথি সেবায় এরা সদা উন্মুখ। তারা তাদের প্রথম ঘরটি সবসমইয় অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখে। সকলের বাড়িতে একটি ঠাকুরঘর থাকে। প্রায় প্রতিটি পরিবার ছাগল, মুরগি, ভেড়া পালন করে। এছাড়াও রয়েছে কমলা বাগান। অকারনে বৃক্ষছেদন এদের খুব অপছন্দ।

উপমহাদেশের অন্যতম শান্তিপ্রিয় এই লেপচা জনগোষ্ঠীরা এখনো অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে। ১৯২৯ সালে Shezum নামে একটি সংগঠন তৈরি হয় যারা লেপচা সংস্কৃতি রক্ষায় ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। তারা যাতে দিন দিন আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারে আমাদের সেই কামনা।

তথ্যসূত্রঃ
১. সিকিমের আদিবাসী লেপচা (লেপচা উপজাতির পূর্নাংগ ইতিহাস), অরুন মৈত্র, এ মুখার্জি অ্যান্ড কোং, কোলকাতা, ১৯৬১, (পৃষ্ঠাঃ১৫-১৮,২৫-১৯,৪৫-৫০,৬৫-৬৯)।
২. সিকিম ও দার্জিলিং এর লুপ্তপ্রায় জনজাতিঃ লেপচা, হরেন ঘোষ।
৩. হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডাল্টন হুকার, দ্বিজেন শর্মা, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৩, (পৃষ্ঠাঃ ১৪,১৭)।

খালিদ আল হাসান (স্বাক্ষর)
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।