পূর্বে আমরা ওসমানীয়দের দুটো বাহিনীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছি। 'দেলি' আর্মি ইউনিট ও 'আকিনজি' আর্মি ইউনিট। এখন আলোচনা করবো 'সিপাহীদের' নিয়ে। 'সিপাহী' শব্দটার সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। বাংলা ভাষায়ও 'সিপাহী' শব্দটির প্রচলন আছে। তবে এখন হয়তো এটি ক্লাসিক একটি শব্দ হয়ে গিয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, সিপাহী শব্দটা কোথা থেকে আমাদের নিকট উড়ে আসলো? এটাতো ব্রিটিশ, পর্তুগীজ কিংবা সংস্কৃত ভাষার শব্দ বলে মনে হয়না। মূলত সিপাহী শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার মধ্যে দুই সুলতান হলো আরবী ও ফার্সি। অনেক ভাষার মধ্যেই তাই ফার্সি শব্দ রয়েছে। যাহোক সেটি আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নয়।  


আরো পড়ুন:
(১) অটোমান সাম্রাজ্য: গেরিলা বাহিনী আকিনজিলার
(২) দেলিলার: অটোমান সাম্রাজ্যের গেরিলা বাহিনী

শিল্পীর তুলিতে ওসমানীয় সিপাহী

'সিপাহী' শব্দটি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ: সৈনিক। এই সিপাহীদের আলবেনিয়ায় বলে 'সিপাহিউ', রোমানিয়ায় বলে 'সেপুহ', আর্মেনিয়ায় বলে 'সিপাহিস' আর গ্রিসে বলে 'স্পাহেয়া' বা 'স্পাহেজা'। বসনিয়া, পর্তুগিজ, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া ও মেসিডনিয়ায় বলে 'সিপাইও' বা 'সেপয়', মালেয়শিয়ার ওদিকটাতে আবার বলে 'সিফাইন'। অর্থাৎ শুরুতেই বুঝতে হবে যে, আমরা এমনই এক ঝানু যোদ্ধাদের ইতিহাস শুনতে যাচ্ছি যাদের নাম পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আজও মানুষ স্মরণে রেখেছে। মজার বিষয় হলো সিপাহীদের সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে ইউরোপীয়রা।
 
সিপাহীরা ছিল ওসমানীয় তুর্কীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এক দুর্বার ক্যাভালরি ইউনিট বা ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা।
সিপাহীরা দুধরনের ছিলো। একটি 'তিমারলি সিপাহী', আরেকটি 'কাপিকুলু সিপাহি'। তিমারলি সিপাহীরা ছিলো প্রাদেশিক সিপাহী আর কাপিকুলু সিপাহীরা ছিলো ওসমানীয় হাউজহোল্ড ডিভিশন। তিমারলিদের সাজানো হয়েছিলো সেসব ওসমানীয় তুর্কীদেরকে নিয়ে যারা ওসমানীয় মিলিটারির সদস্য ছিলো। সানজাক বেয় বা প্রাদেশিক গভর্নরদের কয়েক বছর পরপরই বদলি করা হতো যাতে তারা জমির উত্তরাধিকারী দাবি করতে না পারে (অর্থাৎ নিযুক্ত শাসকরা বেশি দিন একই প্রদেশে বা সানজাকে থেকে যাতে সেই অঞ্চলে নিজেদের উত্তরাধিকারীদেরকে শক্তিশালী করে নিযুক্ত করতে না পারে)।

তিমারলিদের সুলতান কর্তৃক ভূমি দেওয়া হতো, যেখানে তারা অন্যান্য নাগরিকদের মতোই বসবাস করতেন। এই অভিজাত বাহিনীর লোকেরা সেসমস্ত ভূমিতে কৃষকদের সঙ্গেই বসবাস করতেন। রাজস্ব খাত থেকে তাদের প্রশিক্ষণের খরচ তোলা হতো এবং এরা সুলতানের প্রতি খুবই অনুগত ছিলেন। তিমারী সিপাহীদের ভূমি ও সেখানে উৎপাদিত পন্য সাধারণ জনগন ব্যবহার করতে পারতেন।


২.

ওসমানীয় এই ক্যাভালরি মিলিটারী ডিভিশনকে জায়গীর (সামন্ত জমিদারি) দেওয়া হতো। ওসমানীয় সুলতান জায়গীরের পাশাপাশি সিপাহীদের ওসমানীয় উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক পদেও (বেয়লারবেয়) স্থান দিতেন। সেই জায়গীর থেকেই একজন সিপাহী উপার্জন করতেন। তিমারলি সিপাহীগণ তাদের জায়গীরে বসবাসরত লোকদের কর উত্তোলনের করতেন এবং বিনিময়ে জনগনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতেন। তিমারলি সিপাহীগণ তাদের জায়গীর থেকে সৈন্যও সংগ্রহ করতেন। একটি "তিমার" বা জায়গীর ছিল সবচেয়ে ছোট জায়গীর ইউনিট। প্রতিবছর একটি তিমার হতে ২০,০০০ আকজে কর সংগ্রহ করা হতো। ইউরোপীয় লেখকরা বলেন যে, এই ২০,০০০ আকজে তৎকালীন একজন শিক্ষকের বেতনের ৩ থেকে ৪ গুণ বেশী ছিলো। "যিয়ামাত" ছিল বড় জায়গীর যা থেকে ১ লক্ষ আকজে কর সংগ্রহ করা হতো। আর "খাস" ছিল সবচাইতে বৃহৎ জায়গীর। এই খাস জায়গীর থেকে ১ লক্ষের উপর আকজে কর উত্তোলিত হতো।  
   
সিপাহীদের বিশেষ বর্ম

তিমারলি সিপাহীগন তাদের জায়গীর হতে সৈন্য সংগ্রহ করতেন, যাদেরকে 'জেবেলু' বা Armed নামে অভিহিত করা হতো। আবার তুর্কী জমিদারদের জায়গীর থেকে সিপাহীদের নিয়োগ করা হতো। যুদ্ধের সময়ে তিমারলি সিপাহীগণ ও তাদের নিয়োগ করা সৈন্যবৃন্দ একজন রেজিমেন্ট বেয়ের অধীনে জড়ো হতেন যাদেরকে 'আলেয়' বেয় বলা হতো। 'আলেয়' বেয়গণ তার সিপাহী ও সৈন্যদের নিয়ে 'সানজাক' বেয়ের অধীনে জড়ো হতেন। আর সানজাক বেয়গণ বা প্রাদেশিক শাসকগন জড়ো হতেন বেয়লারবেয়দের অধীনে। ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক আসলে রুমেলি বা বলকানের সিপাহীগন রুমেলি বেয়লারবেয়ের অধীনে রাইট ফ্ল্যাংকে যুদ্ধ করার সৌভাগ্য পেতেন।

আনাতোলিয়ার বেয়লারবেয় তার সিপাহীদের নিয়ে থাকতেন লেফট ফ্ল্যাংকে। সেন্টারে থাকতো মধ্যযুগের ভয়াবহতম এক দুর্ধর্ষ বাহিনী ও আর্টিলারী ইউনিট (এই দুর্ধর্ষ বাহিনীর ব্যাপারে সিপাহীদের পরে আলোচনা করা হবে)। আনাতোলিয় ও বলকানের সিপাহীদের সরঞ্জাম ও রণ-কলাকৌশল ভিন্ন ছিলো। আনাতোলিয় সিপাহীগণ ঘোড়া থেকে তীর ছুড়ে মারতেন। আর বলকানের সিপাহীরা বর্শা ও বল্লম ব্যবহার করতেন। তাদের পরনে থাকতো চেইনমেইল বর্ম, যা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেটাল রিং দ্বারা তৈরী চেইনের সমষ্টি ছিলো। সমরাঙ্গনে উভয়ই মিডক্লাস ক্যাভালরি হিসেবে যুদ্ধ করতো।

তেবের কুড়াল

যুদ্ধক্ষেত্রে সিপাহীরা প্রতিপক্ষের ক্যাভালরি ইউনিটের সাথে লড়াই করতো। আর ইনফ্যানট্রি ইউনিট বা পদাতিক সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রের সেন্টারে থেকে লড়াই চালিয়ে যেতো। সিপাহীরা যুদ্ধক্ষেত্রে কঠিন কৌশল ব্যবহার করতেন। যখন সিপাহীদের হ্যাভি ক্যাভালরি আক্রমন করতো তখন তারা রিট্রিট করার নাটক করতো। ফলে দেখা যেত হ্যাভি ক্যভালরি তাদেরকে ধাওয়া করছে। এই সুযোগে অন্য একটি সিপাহী দল ঐ প্রতিপক্ষ দলের পেছনে এসে ক্যাভালরি ইউনিটকে ঘিরে ফেলতো এবং পরিশেষে ঐ হ্যাভি ক্যাভালরি ইউনিটকে কচুকাটা করে দিতো। এর ফলে আস্তে আস্তে প্রতিপক্ষের ক্যাভালরি ইউনিট তাদের পদাতিক বাহিনী থেকে দূরে সরে যেতো এবং সেন্টার ফ্লিট অরক্ষিত হয়ে পড়তো। আর এই সুযোগে ক্যাভালরি ইউনিটকে আলুভাজি বেগুনভাজি করা হতো।

আর্তুগ্রুল টিভি সিরিজের একটি পোস্টার

আনাতোলিয় সিপাহিরা তাদের ঘোড়সাওয়ারী ও আর্চারি বা তীরন্দাজি স্কিল দিয়ে প্রতিপক্ষের হ্যাভি ক্যাভালরি ইউনিটকে কুপোকাত করে ফেলতো। বলকানের সিপাহীরা ব্যবহার করতো রাউন্ড শিল্ড বা বৃত্তাকার ঢাল, তলোয়ার বর্শা ও বল্লম। তাদের ঘোড়াগুলোও রণসজ্জায় সজ্জিত থাকতো। আর আনাতোলিয় সিপাহীরা চামড়া বা পেল্ট বর্ম ব্যবহার করতো। সাথে থাকতো তুর্কী ধনুক ও তুর্কী তলোয়ার 'কিলিজ'। তাছাড়াও উভয় বাহিনী কিছু মুগুড় ও কুড়াল জাতীয় অস্ত্রও ব্যবহার করতো। যেমন- বোযদোগান ও শেশপান মুগুর, আয়দোগান, তেবের ও সাগের কুড়াল। আপনারা যারা আরতুগ্রুল দেখেন তাদের তুরগুত নামে একটা চরিত্র চেনার কথা। তুরগুত খুব বিখ্যাত কুড়াল চালনার জন্য। তিনি যেই কুড়ালটা ব্যবহার করতেন ওটা তেবের কুড়াল।


তথ্যসূত্র: History of the Ottoman Empire and Modern Turkey: Stanford J. Shaw (1976)


Fardin Moshiur Rahman