রাজধানী ঢাকা শহরে বুক ভরে যদি নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা বলা হয় তাহলে চট করেই যে জায়গাটির নাম সবার আগে মনে আসবে, তা হলো রমনা উদ্যান। আরও নির্দিষ্ট করে যদি বলা যায় তা হলে আমরা সকলে রমনা পার্কের কথা মনে করি। রমনা পার্ক রমনা উদ্যানেরই একটি অংশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং রমনা পার্ক নিয়েই হলো রমনা উদ্যান।  

রমনার রূপ ও সৌন্দর্য্য সময়ের ব্যবধানে এক এক জনের কাছে এক এক রকমভাবে ধরা দিয়েছে। কারও কাছে পঞ্চাশ- ষাট বছর আগের রমনা মোহনীয়, আবার কারও কাছে কুড়ি- ত্রিশ বছর আগের ইট- পাথরে ঘেরা এই যান্ত্রিক জীবনে নির্মল বায়ু শোধনাগার হিসেবে ধরা দিয়েছে রমনা। একসময় পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে শুরু করে রমনা পার্ক, রমনা পার্ক থেকে মিন্টো রোড, শাহবাগ, বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো নীলক্ষেত এলাকা, কার্জন হল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত পুরো এলাকেই বোঝানো হতো রমনা উদ্যান বলে।  


মুঘল আমলের সেই ১৬১০ সাল থেকেই রমনা বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতীর বংশের কিছু কিছু পরিবার সেই আমলে এ এলাকায়  বসবাস করতেন। রমনার নামকরন করা হয়েছিল মুঘল আমলেই। পুরোনো হাইকোর্ট ভবন থেকে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মুঘলরা তৈরী করেছিলেন একটি বৃহদাকার বাগান। যার নাম ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ বা 'বাদশাহী বাগান'। এই বাগানের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল বসবাসের জন্য ঘরবাড়ী। বাগানের মাঝখানের জায়গাটুকু জুড়ে ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর যা পরবর্তীতে ইংরেজ আমলে তৈরী হয়েছিল ঘোড় দৌড়ের জন্য ‘রমনা রেসকোর্স ময়দান’ হিসেবে।

রমনা এলাকার ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল দু- একটি ক্যানেল বা খাল, যার একটি রমনা পার্কের ভেতর এখনও অর্ধমৃত অবস্থায় প্রবাহমান। বর্তমানে এই জলাশয়কে আমরা রমনা লেক বলে জানি। এসব ক্যানেলে তৎকালীন অভিজাত নাগরিকগণ বিশেষ করে নবাব পরিবারের সদস্য ও ইংরেজরা বিকেলে বিশেষ নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন।

কথিত আছে, মুঘল আমলেই পত্তন ঘটে হাইকোর্ট মাজারের। ১৬৭৯ সালে সুবাদার মুহাম্মদ আজমের আমলে রমনার দক্ষিণে মাজারের পাশেই নির্মিত হয়েছিলো হাজী শাহবাজের মসজিদ যা হাইকোর্ট মাজার মসজিদ নামে অধিক পরিচিত। জানা যায় সতেরো শতকের প্রথমভাগে রমনা কালী মন্দিরটিও নির্মিত হয়েছিল রমনা উদ্যানে।

মুঘল আমলের শেষ দিকে রমনার ক্ষয় শুরু হয়। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার সিংহাসনে আসীন হলে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারানোর পর থেকে রমনা এলাকা বিরান ভূমিতে পরিনত হয়। ঢাকা শহরের বাগানগুলো অযত্নে- অবহেলায় তখন জঙ্গলে পরিণত হয়েছিলো। এর ধারাবাহিকতায় রমনা উদ্যানও হয়ে পড়েছিলো জঙ্গলাকীর্ণ। লোক সংখ্যাও গিয়েছিলো কমে। জঙ্গলের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল পুরোনো ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। শহরের খালগুলোও ভরাট হতে থাকে একে একে। রমনা উদ্যান তখন এমন জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়েছিল যে লোকজন নেহায়েত কোনো প্রয়োজন না পড়লে রমনার ধারে কাছেও ঘেঁষতো না।
 
   
ইংরেজ আমলে, রমনা উদ্যানের পুনরুদ্ধার কাজে হাত দিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চালর্স ডস। ঢাকা শহর উন্নয়নের জন্য তখন একটি কমিটি করা হয়। তিনি সে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনাকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য চাই প্রচুর জনবলের। অর্থ খরচ করে এত জনবল নিয়োগ করার মতো বাজেটও তখন ছিল না। বিনা পারিশ্রমিকে এত জনবল কোথায় পাওয়া যায়? শেষ পর্যন্ত চালর্স ডস ১৮২৫ সালে ঢাকা জেলখানার কয়েদীদের নিয়ে রমনার জঙ্গল পরিস্কারের কাজে নেমে পড়েছিলেন। টানা তিনমাস জঙ্গল পরিস্কারের পর বের করা হয়েছিলো ডিম্বাকৃতি একটি অংশ, সেই ডিম্বাকৃতি অংশটিকে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘিরে তারা তৈরী করেছিলেন ঘোড়া দৌড়ের জন্য রেসকোর্স।
   

মূল শহরের সাথে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ডস রেসকোর্সের উত্তর- পশ্চিম দিকে তৈরী করেছিলেন একটি রাস্তা যা বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে নজরুল এভিনিউ থেকে বাঙলা একাডেমী হয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে চলে গেছে। এই রাস্তার দু’ধারে লাগিয়েছিলেন দুষ্প্রাপ্য মিমোসা বা ক্যাসুরিনা গাছ যার অনেকগুলি সংগ্রহ করা হয়েছিলো নেপাল থেকে। এই রাস্তার প্রবেশমুখে তারা আরো তৈরী করেছিলেন দুটি স্তম্ভ যা আমরা অনেকেই মীর জুমলা ফটক নামে জানি। অনেকে এটি ঢাকা শহরে প্রবেশদ্বার হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য মীর জুমলার সময়ে তৈরী হয়েছিল বলে ধারনা করেন। কিন্তু পরবর্তিতে তা ভুল প্রমানিত হয়। এই গেটের স্তম্ভ দুটো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এগুলো ইউরোপীয় ও মুঘল স্থাপত্য নকশার সংমিশ্রণে তৈরী। কারণ মুঘল আমলে ইউরোপীয় নকশা এদেশে আমদানীর কোনো সুযোগই ছিল না। তাতেই প্রমানিত হয় যে, এই গেটটি ইংরেজ আমলেই তৈরী। রমনা উদ্যানের ঠিক উত্তরে ইংরেজরা একটি ক্লাব গড়ে তোলে যা 'ঢাকা ক্লাব' নামেই সমাধিক পরিচিত। চালর্স ডস কর্তৃক পুনরুদ্ধারের পর এভাবেই রমনা হয়ে ওঠে ইউরোপীয় ও ঢাকার অভিজাত শ্রেনীর মানুষের জন্য প্রমোদ ভ্রমনের অবাধ উদ্যান।

১৮৪৪- ৪৫ সালে ঢাকার নবাব আব্দুল গনি রমনার বিস্তীর্ণ এলাকা অর্থাৎ বর্তমানে বাংলা একাডেমী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, পরীবাগ, ঢাকা ক্লাব পর্যন্ত কিনে নিয়েছিলেন। উল্লেখিত এলাকা ক্রয় করার কয়েক বছরের মধ্যে আব্দুল গনি তাঁর বাগানবাড়ী নির্মাণ শুরু করেন। পাশাপাশি ছোট- বড় দালান কোঠা, দরবার কক্ষ ও বিস্তৃত বাগান নির্মাণ করেন। পরবর্তিতে নবাব আহসানউল্লাহ’র আমলে রমনা এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন হয়। তিনি রমনায় অল্প পরিসরে একটি চিড়িয়াখানাও তৈরী করেছিলেন। এই চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ভাল্লুক, হাতীসহ প্রচুর চিত্রাহরিণ সংরক্ষণ করা হতো। বস্তুতঃ আঠারো শতকের নব্বই দশকেই রমনা হয়ে উঠেছিলো মোটামুটি পরিচ্ছন্ন এলাকা।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর সত্যিকারভাবে গড়ে উঠতে থাকে রমনা এলাকা। এসময়েই সরকার রমনার পূর্ব ও দক্ষিণের অনেকটা অংশ নিয়ে নিয়েছিলো তৎকালীন আসাম ও পূর্ব বাংলা মিলিয়ে গঠিত পূর্ববঙ্গের নতুন রাজধানী নির্মাণের জন্যে। এখানে গড়ে উঠেছিলো লাটভবন (পরবর্তীতে পুরোনো হাইকোর্ট), কার্জন হল, সচিবালয়, সরকারী কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকার জন্য মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ইত্যাদি। প্রকৃতির সবুজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাড়িগুলোর রং করা হয়েছিলো লাল। এ সময়ই গোড়াপত্তন হয়েছিলো রমনা পার্কের। রমনা এলাকা তখন মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত: রমনা আবাসিক এলাকা, রমনা পার্ক ও রমনা রেসকোর্স।
 


১৯০৮ সালে নিসর্গ ঢাকা শহরের পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিলো। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অন্যতম কর্মী মি: আর. এল. প্রাউডলকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা শহরের পরিকল্পনার অন্যতম অংশ হলো এই রমনা পার্ক। এই পার্ককে সাজানোর জন্য তখন ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। পার্কের সবুজ প্রান্তরের চারিদিকে রাস্তা করে রাস্তার ফুটপাত বরাবর লাগানো হয়েছিলো কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি (এখন অবশ্য গাছগুলো নেই)। পার্কের পূর্ব পাশে নির্মাণ করা হলো বিচারপতি, সচিব থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সরকারী অধিকর্তাদের আবাসস্থল। পরিকল্পনা অনুসারে রমনা পার্কের ভেতর নানা প্রকার দেশী বিদেশী ফুল, ফল, ঔষধী গাছ, হাঁটার জন্য পার্কের ভেতরের চারিদিকে ওয়াকওয়ে, শিশুদের বিনোদন ব্যবস্থাসহ গল্ফ কোর্স নির্মাণ করা হয়। পার্কের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ক্যানেলকে পুনর্গঠিত করে নৌকা ভ্রমনের জন্য লেক তৈরী করা হয় এবং লেকের পাশে একটি রেস্টুরেন্টেরও ব্যবস্থা করা হয়। এ কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিলো কুড়ি বছর।

রমনা পার্ক আজও ঢাকাবাসীর চিত্তবিনোদন ও শারীরীক স্বাস্থ্য রক্ষায় অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে চলেছে। বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে একদন্ড নির্মল বায়ু সেবনের উপযুক্ত স্থান এই রমনা পার্ক। একারনেই ভোর না হতেই শিশু- কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধবয়সী সকল শ্রেনীর নাগরিকগণ প্রাতভ্রমণের জন্য ছুটে যান রমনা পার্কে।    

লেখক: এ কে এম শামসুদ্দিন
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা