সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী:


মুক্তাগাছার জমিদারদের মধ্যে মহারাজ সূর্যকান্ত ছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপের অধিকারী। ১৮৬৩ সালে লক্ষীদেবী মারা গেলে সূর্যকান্ত তখন নাবালক থাকায়, জমিদারি সরকার প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ "কোর্ট অব ওয়ার্ডস" এর অধীনে চলে যায়।








সরকার সূর্যকান্তের সম্পত্তি স্বীয় তত্ত্বাবধানে রেখে তাকে কোলকাতা এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনে প্রেরন করে। সেখানে ৩ বছর পাঠগ্রহণ

করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সূর্যকান্ত নিজেকে সব কিছুর জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলেন।

১৮৬৬ সালে বর্তমান রাজশাহী জেলার কলম গ্রাম নিবাসী ভবেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্তীর বড় মেয়ে "রাজরাজেশ্বরী" এর সাথে সূর্যকান্তের বিয়ে সম্পন্ন হয়।


প্রথম জীবনে সূর্যকান্ত স্বাভাবিকভাবেই বিলাসপ্রিয় ও অলস প্রকৃতির ছিলেন। অধিকাংশ সময় কাটাতেন আমোদে প্রমোদে। পরবর্তীতে তিনি সচেতন হয়ে, নিজ কর্মের মাধ্যমে নিজেকে কর্মবীর করে তোলেন।


তখন বাংলায় প্রথম বৃহত্তম জমিদারি এস্টেট স্থাপিত হয়ছিল ঢাকার নবাব এস্টেট সম্মিলিত হয়ে। সূর্যকান্ত ছিলেন দ্বিতীয় বৃহত্তম এ্যাস্টেটের জমিদার।

১৮৭৭ সালে পহেলা জানুয়ারি তিনি দিল্লির রাজ্যভিষেক দরবারে তাকে "রায় বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

পরবর্তীতে ১৮৮০ সালে লর্ড লিটনের শাসনামলে তাকে গৌরবময় "রাজা "উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এর সাত বছর পর মহারানী ভিক্টোরিয়া রাজত্বকাল জুবিলী দরবারে তাকে "রাজা বাহাদুর" উপাধি প্রদান করে গৌরবান্বিত করা হয়।

১৮৯৭ সালে তিনি লাভ করেন বিরল সম্মানের প্রতীক "মহারাজ" উপাধি।





মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, বিদ্যাশিক্ষার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলেন। সে সময় পূর্ববঙ্গে কেবল ঢাকাতেই একটি কলেজ ছিল (বর্তমানের ঢাকা কলেজ)। ১৮৭২ সালে তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বিপুল অর্থ দান করেন (প্রকৃত অর্থের পরিমান জানা যায়নি)।

১৮৮৪ সালে তিনি ময়মনসিংহের অধিবাসীদের কল্যাণার্থে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহ শহরে একটি টাউন হল নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এই টাউনহলের এক অংশে সাধারণ গ্রন্থাগারও ছিল।


কলকাতার "কটন ইনস্টিটিউশন" ও "মুকবধির বিদ্যালয়" তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৮৭ সালে ময়মনসিংহ শহরে "সিটি কলেজ" প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৬৫০০ টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও শিক্ষার ব্যাপারে সূর্যকান্ত অকৃপণভাবে দান করেছিলেন।জাতীয় শিক্ষা সমিতিকে তিনি বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষা সমিতিকে বিপুল সম্পত্তি দান করেছিলেন, যার মূল্যমান ১০০০০ টাকা।


মহারাজ সূর্যকান্তের প্রচেষ্টায় ১৮৭৫ সালে মুক্তাগাছা পৌরসভা স্থাপিত হয় ।




সূর্যকান্ত ছিলেন যথার্থ অর্থেই পত্নী প্রেমিক।

১৮৮৯-৯০ সালে তিনি মৃত পত্নী রাজরাজেশ্বরী দেবীর স্মৃতি রক্ষা জনস্বাস্থ্য ও সুপেয় পানির অভাব পূরণে "রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস" নামক পানীয় জলের কল স্থাপন করেন। এজন্যে ১১২৫০০ টাকা খরচ হয়েছিল। পানীয় জলের কল স্থাপিত হওয়ার ফলে শহরের জনগণ অতিশয় সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে অনেকটা রক্ষা পায়। রাজরাজেশ্বরী দেবী তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।কারণ তিনি যখন মরণ পথযাত্রী তখনো তাকে পিপাসা নিবারণের প্রয়োজনে পানি পান করানো সম্ভব ছিল না। তা করলে রোগের মাত্রা বেড়ে যাবে। মহারাজ সূর্যকান্ত শহরবাসীর জন্য সুপেয় জলের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে এবং কষ্টে মারা যাওয়ার শোকাবহ স্মৃতিকে লাঘব করার জন্য রাজ রাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন।




জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারেও সূর্যকান্ত বেশ যত্নশীল ছিলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তাগাছা শহরে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন এবং এটি পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে ১৬ হাজার টাকা প্রদান করেন।


তিনি "মেকেঞ্জি আই ওয়ার্ড" নামে ময়মনসিংহ হাসপাতালে একটি চক্ষু ওয়ার্ড স্থাপন করেছিলেন।

১৮৮৭ সালে তিনি ঢাকা নগরীতে "টমসন মেডিকেল হল" নির্মাণের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন, এজন্য তিনি 10 হাজার টাকা দান করেন। দার্জিলিং স্বাস্থ্য নিবাস নির্মান কল্পে সূর্যকান্ত ৩০০০ টাকা প্রদান করে। তিনি "ত্রিপুরা সুন্দরী "নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন এটি তার স্মৃতি রক্ষার্থে স্থাপিত হয়েছিল। এছাড়াও শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে আরো নানা দান ও সহায়তা মহারাজা সূর্যকান্ত প্রদান করেছিলেন।


১৮৮৩ সালে তিনি মুক্তাগাছার নিকটবর্তী সুতিয়া নদী সেতু নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থার নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। এই সেতু নির্মাণে অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের নির্মাণের নিমিত্তে তিনি প্রায় ৩০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। মহারাজ সূর্যকান্তের এই দানকৃত জমির তৎকালীন মূল্য ছিল দুই লক্ষ টাকা যা তিনি গ্রহণ করেননি।



ব্রহ্মপুত্র নদে জনসাধারণের সুবিধার্থে, তিনি একটি উৎকৃষ্ট ঘাট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন যাতে ২০০০ টাকা খরচ হয়েছিল। ময়মনসিংহ-মুক্তাগাছা সড়কের "মনতলা" নামক স্থানে, যে সেতু নির্মিত হয়েছে তা নির্মাণ করেছিলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।

ময়মনসিংহ শহরের মহারাজার রাজবাড়ি সংলগ্ন যে বড়বাজারটি "মেছুয়া বাজার "নামে পরিচিত সেটিও নির্মাণ করেছিলেন তিনি।



কোলকাতা নগরীতে অবস্থিত চিড়িয়াখানার উন্নতিকল্পে তিনি ২৫ হাজার টাকা প্রদান করেছিলেন।


সূর্যকান্ত ছিলেন ঐতিহ্যসচেতন ও সৌন্দর্যপিপাসু রাজা। তিনি মৃত ভারত সম্রাট এডওয়ার্ড ও তার স্ত্রী সঙ্গী আলেকজান্ডারের তৈলচিত্র করেই ক্ষান্ত হননি, তার বিশাল বাড়িতে এখনো ইতিহাস হয়ে সাক্ষ্য বহন করছে আলেকজান্ডার ক্যাসেল।





সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর "মহারাজ" উপাধি প্রাপ্তি উপলক্ষে, বাংলার তৎকালীন শাসনকর্তা Sir Alexander Mackenzie এক অভিভাষন প্রদান করেন।


এই অভিভাষণ এর মর্মবাণী হচ্ছে:

"মহারাজ সূর্যকান্ত আপনি উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া স্বীয় অভিজাত্যের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছেন। "রাজা", "রাজাবাহাদুর" এবং পরিশেষে "মহারাজ" উপাধি পেয়ে আপনার মহত্বকে গৌরবমণ্ডিত করিয়াছেন! আমি আশা করি, আপনি বঙ্গের ভূস্বামীগণের আদর্শস্থল হইয়া থাকিবেন"



দুঃখজনক হলেও সত্য যে মহারাজ সূর্যকান্তের পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না। একদিকে তিনি রাজ সম্মান লাভ করছিলেন অন্যদিকে লাভ করছিলন প্রজাদের শ্রদ্ধা। কিন্তু, যদি পারিবারিক জীবনে সুখ থাকতো তাহলে তার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হত।


তারুণ্যের প্রথম প্রহরেই সূর্যকান্ত বিয়ে করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে তিনি রাজরাজেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর সুখময় দাম্পত্য জীবন যাপন করলেও অল্পদিনের মধ্যেই তাদের দাম্পত্য জীবনে বেদনার কালো ছায়া নেমে আসে। রাজরাজেশ্বরী দেবীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। ময়মনসিংহ ও কলকাতার বিজ্ঞ চিকিৎসকগণ প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ করতে পারেননি। দীর্ঘ ১১ বছর রোগ যন্ত্রণা ভোগ করে ১৮৮৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি দেহত্যাগ করেন।


মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী শিকার করতে খুবই পছন্দ করতেন। তার শতাধিক সুশিক্ষিত শিকারি হাতি ছিল। সেই ছোটবেলা থেকে মহারাজ সূর্যকান্ত শিকারপ্রেমী ছিলেন। শিকারের ব্যাপারে মহারাজ সূর্যকান্তের এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে ইউরোপের বিখ্যাত শিকারীরা সূর্যকান্তের শিকারের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ শিকারি স্যার স্যামুয়েল বেকার একবার সূর্যকান্তের সাথে শিকারে গিয়েছিলেন। তার সাথে গণ্যমান্য যারা শিকারে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ভারতের ভূতপূর্ব প্রধান সেনাপতি, স্যার জর্জ হোয়াইট, হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ক্রোমার পেথারাম, রাশিয়ার রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী গ্র্যান্ড ডিউক বরিস এবং ভারতের বড় লাট লর্ড কার্জন বাহাদুর প্রমুখ।





সাহিত্যসেবী হিসেবেও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট। ১৮৮৯ সালে তিনি "জমিদারি কার্যের নিয়মাবলী" নামক গ্রন্থ রচনা করে সরল ও সৎ উপায়ে জমিদারি কার্য পরিচালনার কৌশল উদ্ভাবন করেন। ১৯০২ সালে শিকার সংক্রান্ত বিচিত্র কলা-কৌশল নিয়ে রচনা করেন "শিকার কাহিনী"।


নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, মহারাজ সূর্যকান্ত ছিলেন বঙ্গের আদর্শ জমিদার। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছরের জমিদারী কার্য পরিচালনার করেন।

সূর্যকান্ত প্রজাসাধারণের অভাব-অভিযোগ এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। বিপদগ্রস্ত প্রজাসাধারণকে আর্থিক সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রেও কৃপণতা প্রদান করেননি। এভাবে সুকৌশলে তিনি ন্যায় পরায়নতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৫ বছরের মধ্যে তার জমিদারি দ্বিগুণের অধিক বেড়ে গিয়েছিল।


যে কেউ তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে মহারাজ সূর্যকান্ত ইতিবাচক সাড়া দিতেন। উদাহরণস্বরূপ- ঢাকার পরলোকগত নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর বাল্যকাল থেকে অমিতব্যয়ী ছিলেন। যার জন্য তার পিতা আহসানুল্লাহ বাহাদুর তাকে পছন্দ করতেন না। ঢাকার কমিশনার, বাহাদুর নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে অল্প বয়সে ময়মনসিংহে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ করে পাঠান। দুই বছর পর যখন তিনি বদলি হন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে বিভিন্নভাবে তার প্রায় ৫০ হাজার মুদ্রা ঋণ হয়ে গেছে। পিতা কিংবা ঢাকার অন্য কোন বন্ধুর কাছে কোন সাহায্য প্রাপ্তির আশা করাও তখন অসম্ভব ছিল তার জন্য। মহারাজ তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ৫০০০ টাকা প্রদান করেন এবং মহারাজ তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ৫০০০ টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে কলকাতার বিখ্যাত পান্থনিবাস, নবাব সলিমুল্লাহর টাকা বাকি করে মহারাজের শরণাপন্ন হলে মহারাজ তার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করে দেন। স্বর্গীয় মহারাজ সূর্যকান্তের পুত্র মহারাজ শশীকান্ত আচার্য যখন ১৯১৩ সালে বঙ্গদেশের জমিদারি গণের প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন নবাব সলিমুল্লাহ স্বজাতীয় জমিদারের নিষেধ সত্ত্বেও, মহারাজ শশীকান্ত আচার্য নির্বাচনে জয়ের জন্য পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন।


১৯০২ সালে ভারতের রাজপ্রতিনিধি লর্ড কার্জন সস্ত্রীক বঙ্গের অতি অতি প্রাচীন রাজধানী গৌড় এর ভগ্নাবশেষ পরিদর্শনের জন্য ভ্রমণ করেন। ওই স্থান মহারাজ সূর্যকান্তের অধিকারভুক্ত ছিল। তিনি অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেন কিন্তু অসুস্থ থাকায় স্বয়ং উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি নিজে উপস্থিত থাকতে না পারায় নিজ পুত্র শশীকান্ত আচার্য কে সেখানে প্রেরণ করেন।


মহারানী রাজরাজেশ্বরী পরলোক গমন করলে মহারাজের ভাবি উত্তরাধিকারী বলতে কেউ থাকলো না। এ কারণে ১৯৮৭ সালে তার চাচাতো ভাই রাজা জগৎ কিশোর আচার্যের দ্বিতীয় পুত্র শশীকান্ত আচার্যকে দত্তক স্বরূপ গ্রহণ করেন। মহারাজ সূর্যকান্ত তাকে নানাভাবে সুশিক্ষিত ও যোগ্য গড়ে তোলেন। ১৯০৪ সালে ২০ জুন কলকাতা নগরীর বিখ্যাত ব্যারিস্টার শ্রীযুক্ত ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর তৃতীয় কন্যা শ্রীমতি লীলা দেবীর সঙ্গে, তাঁর পুত্র শশীকান্ত আচার্যের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিয়ে সম্পাদনের পর মহারাজ তার পুত্র ও পুত্রবধু কে নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে উপস্থিত হলে শহরবাসী বিরাট সভা করে তাকে অভিনন্দিত করে।

১৯০৮ সালের শুরুতেই মহারাজ সূর্যকান্তের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। ১৯০৮ সালের শেষে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করেন।এজন্য তিনি পুত্রবধূ ও পুত্রের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বৈদ্যনাথস্হ বাসভবনে গমন করেন। সে বছরের ২০ অক্টোবর রাতে ৫৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


এভাবেই শেষ হয় একজন প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী অথচ ন্যায়পরায়ণ জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর বর্ণাঢ্য ইতিহাস।




শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী:


মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের মতই যোগ্য ও প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন তাঁর পুত্র শশীকান্ত আচার্য। শশীকান্ত আচার্য জন্ম১৮৮৫ সালে। তিনি ছিলেন মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের চাচাতো ভাই রাজা জগৎ কিশোর রায়চৌধুরীর দ্বিতীয় পুত্র। ১৮৮৭ সালে মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য, দত্তকপুত্র হিসেবে শশীকান্ত আচার্য কে গ্রহণ করেন। মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য উপযুক্ত শিক্ষা এবং নিজের আদর্শে দত্তকপুত্র কে গড়ে তোলেন।


সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর পুত্র শশীকান্ত আচার্য পিতার আদেশ-নিষেধ ঠিকভাবে পালন করতেন। শশীকান্ত আচার্য ১৯০৪ সালে সেন্ট জেভিয়ার স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ায় তিনি ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতেন, যার ফলে তার শরীর হয়ে উঠেছিল বলিষ্ঠ। শশীকান্ত আচার্য এর স্ত্রী লীলাদেবী ছিলেন তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিনী। তাদের বিয়ে হয়েছিল ধুমধাম করে বিয়ে উপলক্ষে কলকাতা মহানগরীতে সাত দিন যাবত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৫ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য শশীকান্ত আচার্য বিলেত ভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালের অক্টোবরে তাঁর পিতৃবিয়োগের পর তিনি জমিদারি গ্রহণ করেন।


ঠিক ওই সময় লীলাদেবীর পিতৃবিয়োগ হয়। জীবদ্দশায় পুত্রবধূ লীলাদেবীর সঙ্গে পুত্রের সকল বিষয়ে মিল দেখে সূর্যকান্ত প্রীত হয়েছিলেন। সূর্যকান্তের জীবনাবসানের মাধ্যমে মুক্তাগাছা জমিদারীতে যে সূর্য অস্ত গেল তা শশীকান্তের মাধ্যমে দীপ্তিময় হয়ে উঠলো। ইংরেজ সরকার ১৯১৩ সালে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর "রাজা বাহাদুর" উপাধি দান করে।




পিতার অবর্তমানে পিতার সব দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এক পর্যায়ে ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২১ সালে তিনি ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার পুত্র সুধাংশু কান্ত আচার্য্য চৌধুরী ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।


১৯২০ সালে শশীকান্ত "মহারাজ" উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯২০ সালের ৪ আগস্ট ঢাকার দরবারে তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তা Lord Ronaldshey নিজ হাতে মহারাজ শশীকান্তকে "মহারাজ" সনদ প্রদান করেন। এই উপলক্ষে শাসনকর্তা শশীকান্ত কে উদ্দেশ্য করে বলেন-


"you are the head of the distinguished jamidar family of Muktagacha in Mymensingh and as such the most influential Hindu nobleman of Eastern Bengal. Your father, the late Maharaja Surya Kant Acharya Chaudhary was distinguished for the liberal assistance he gave to works of public utility and in his footsteps you are following. It gives me great pleasure to handover you the sanad of the high title of Maharaja. May you live long to enjoy the title and to carry on the high traditions of your family."


শশীকান্ত ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে গৌড়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং এজন্য খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলার ছোট লাট লর্ড কারমাইকেল ও ছিলেন তার বিশেষ প্রশংসা ভাজন। ভারতের এককালীন সম্রাট এডওয়ার্ডের স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে এক লক্ষ এক টাকা দান করেন। স্থানীয় বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয় জয়দুর্গা বিদ্যালয় ও তিনি অনেক অর্থ দান করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি "সৈন্য সংগ্রাহক সমিতির" সভাপতি ছিলেন।


মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য তার পুত্র শশীকান্ত আচার্য নামানুসারে ময়মনসিংহে বিলাসবহুল "দিতলী প্রাসাদ" নির্মাণ করেন। কিন্ত ১৮৯৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পে প্রাসাদটি ভেঙে যায়। ১৯০৫-১৯১১ সালে শশীকান্ত আবার প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। প্রায় 9 একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত ছিল। এখন তার কিছু অংশে অবশিষ্ট রয়েছে।





মহারাজ শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর মুক্তাগাছার বাসভবনেই বর্তমানে মুক্তাগাছা সরকারি কলেজটি অবস্থিত (শহীদ স্মৃতি কলেজ)।

মহারাজ সূর্যকান্তের প্রতিষ্ঠিত "আলেকজান্ডার ক্যাসেল" বর্তমানে "টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পুরুষ)" এবং শশি লজে "টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা)" অবস্থিত।

মহারাজ শশীকান্ত পিতার মতোই নিপুন শিকারি ছিলেন। ময়মনসিংহ পার্বত্য প্রদেশ আসামে উপত্যকা ভূমিতে তিনি শিকার করতেন। তার সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন- ১৯১০ সালে Ireland এর অভূতপূর্ব Lord lieutenant Wimborne and lady Wimborne, স্পেনের Duke of Peneranda, ১৯১৩ সালে মিশরের সুলতানের পুত্র Yosuf Kamal Pasha.


মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য ছিলেন, মুক্তাগাছা জমিদারী প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চতুর্থ পুত্রের উত্তরাধিকারী। চতুর্থ পুত্র শিবরামের অধস্তন পুরুষদের জমিদারি বিষয়ে যে সুনাম ছিল তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জমিদারি ভাব নমুনায় তারা ছিলেন প্রাণবন্ত।





তথ্য সংগ্রহ:

"ময়মনসিংহের রাজপরিবার" -আব্দুর রশিদ

"ময়মনসিংহের জমিদারী ও ভূমিস্বত্ব" - মোঃ হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া !

ছবি সংগ্রহ: "নাটোরের ইতিহাস"- সমর পাল




আবিদ আল মুদাব্বির
ইতিহাসনামা.কম এর প্রধান কনটেন্ট রিসার্চার। ইতিহাসের পাতায় ডুবে থাকতে ভালবাসেন। যেখানে লোকের বিশ্বাস "বর্তমানে বাঁচো এবং ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করো",সেখানে তিনি বিশ্বাস করেন, অতীত ইতিহাসের পাতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলায়!