যুদ্ধবাজদের জন্য লজ্জাজনক ইতিহাস: ভিয়েতনাম যুদ্ধ - লিখেছেন - শরফুদ্দিন চিশতী
সুচতুর রণকৌশল আর অদম্যসাহস ভিয়েতনামীদের বিশ্বের পুজিবাদী শক্তির মাথা, সামরিক প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠ আমেরিকা (USA) কে মাথা নত করতে বাধ্য করে।
আমেরিকার সেনারা এই যুদ্ধে প্রায় ৩ লক্ষের কাছাকাছি আহত হয়ে কষ্টের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়েছে। ২০০ বিলিয়নের কাছাকাছি অর্থ, ৪০ লাখের কাছাকাছি বোমা, "নাপাম" রাসায়নিক গ্যাস, ৭০০-৮০০ আকাশযান দিয়েও লজ্জাজনক হার দিয়ে ভিয়েতনাম ছাড়ে আমেরিকান সেনারা। লজ্জার এক স্মৃতি নিয়ে যায় সাথে।
১৯৫৫ সালে শুরু হয়ে ১৯৭৫ সাল দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধে আমেরিকা হারিয়েছে ৫৮,২০০ জন সৈনিক। যুদ্ধ শেষে উত্তর ভিয়েতনাম ৫৯১ জন যুদ্ধ বন্ধীকে ফেরত দিলেও ১২০০ জন নিহত আমেরিকান সেনার লাশও ফেরত পায় নি আমেরিকা(USA)। আনুমানিক ৩,০৩,৬৩০ জন আমেরিকান সেনা আহত হয়েছিল এই যুদ্ধে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধ বিশ্বকে দেখিয়েছিল কিভাবে আমেরিকার মত সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে বুদ্ধি আর সাহসের জোড়ে নাকানিচুবানি খাওয়ানো যায়।
একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন ভিয়েতনাম দুইভাগে ভাগ করা হয়েছি ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসন শেষ হবার পর। উত্তর ভিয়েতনাম ছিল কমিউনিস্ট শাসিত ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছিল পুজিবাদী আমেরিকানের মদদপুষ্ট। অনেকটা কোরিয়ার মত। উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামকে দখল করে ভিয়েতনামকে এক করতে চেয়েছিল ও পুজিবাদকে ভিয়েতনাম থেকে তাড়াতে। তাদের ২০ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামই হল ভিয়েতনাম যুদ্ধ সোজা ভাষায়।
প্রথমেই
(১) ভিয়েতনামের জঙ্গলময় প্রকৃতি;
(২) ভিয়েতনামীদের প্রকৃতির উপাদানকে যুদ্ধের ফাদ হিসেবে অভিনব ব্যবহার;
(৩) ভিয়েতনামীদের পাতাল সুরঙ্গে ক্যাম্প নির্মাণ;
(৪) সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল সহায়তা;
(৫) গুপ্ত বাঙ্কার নির্মাণ;
(৬) গ্রামবাসীর ছন্দবেশ ধারণ;
(৭) আমেরিকান অস্ত্রের recycling;
ভিয়েতনামের জঙ্গলময় প্রকৃতি :
সেই সময় ভিয়েতনাম একটি বন-জঙ্গলে ঘেরা ও অনুন্নত দূর্গম যোগাযোগ কাঠামোর একটি দেশ। আমেরিকান সেনাদের প্রধান যুদ্ধকৌশলই ছিলadvanced weapons দিয়ে Air strike করা । যুদ্ধে তাদের এয়ার সুপিরিয়রিটি(Superiority ) ছিল অপারাজেয়।
কিন্তু ঘন জঙ্গলে আকাশ থেকে বিমান হামলা করে আমেরিকান সৈন্যরা বেশি সফলতা পেত না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের জঙ্গলে লুকাছুপি যুদ্ধে অর্থাৎ জঙ্গল ওয়ারফেয়ারে(Jungle warfare) যেতে বাধ্য হয়েছিল। আর ভিয়েতনামী গেরিলা ছিল এতে খুবই দক্ষ । ফলে আমেরিকানদের ট্যাপে(trap) ফেলে ফেলে ভিয়েতনামী গেরিলারা হত্যা করে।অসংখ্য আমেরিকান নিখোঁজ হয়েছিল এসব যুদ্ধে সংখ্যাটা আনুমানিক ১৬,০৯০।
ভিয়েতনামীদের প্রকৃতির উপাদানকে যুদ্ধের ফাদ হিসেবে অভিনব ব্যবহার :
ভিয়েতনামী গেরিলাদের অস্ত্রের অপ্রতুলতা ছিল। উত্তর ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত এবং চীনের সাহায্য পেলেও সেটা যথেষ্ট ছিল না। গেরিলারা দক্ষিণ ভিয়েতনামী পুলিশদের আক্রমণ করে তাদের অস্ত্র লুট করতো। যুদ্ধ লড়ার জন্য তাদের মাটিতে পুতে রাখা মাইনেরও অভাব ছিল। কিন্তু এই সমস্যা তারা সমাধান করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তারা প্রকৃতি থেকে পাওয়া বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে। যেমন-
(১)বাঁশ,
(২)ডাব গাছের ডাবে লম্বা আলপিন দিয়ে,
(৩)কাটাযুক্ত গাছের মোটা ডাল দিয়ে বিভিন্ন ভয়ানক অস্ত্র বানিয়ে ছিল।
ডাবের মধ্যে লম্বা লম্বা লোহার পিন ঢুকিয়ে একটি অস্ত্র যেটি গাছের উপরে ঝুলিয়ে রাখা হত। নিচে একটি ফাদ পাতা হত। যেন আমেরিকান মাথায় ক্যাপ পড়ে আছে এমন কেউ ফাদে পা দিলে উপর থেকে ডাবটি তার উপর পড়ে। ভাবতেই পারছেন এটি যে ব্যক্তির মাথার উপর পড়বে তার কি অবস্থা হবে।
ছবি সোর্সঃ Eugene Taylor & Abraham krikorian YouTube channel
এছাড়া মাটি গর্ত করে বাশ/ কাঠ ও লোহার পেড়েক দিবে তৈরী ফাদ যেগুলোতে ভুলে কোন সৈন্য পা দিলেই গুরুতরভাবে আহত হয়ে যেত এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মত কোন পরিস্থিতি থাকতো না সেই সৈনিকের।
এটি পানির নিচে রাখা হত যদি কোন সৈন্য ভুলে এই ট্যাপে পা ফেলতো, সে না বুজে উপরে জোর করে পা টান দিলেই পা চিড়ে যেত।
ভিয়েতনামীদের পাতাল সুরঙ্গে ক্যাম্প নির্মাণঃ
আমেরিকানরা প্রথম দিকে বিমানের মাধ্যমে আকাশ থেকে প্রচুর বোমা বর্ষণ করলেও গেরিলাদের নির্মূল করা যাচ্ছিল না। আকাশ থেকে ঘন জঙ্গলের ভেতরটা দেখা যেত না। ফলে ভিয়েতনামী গেরিলারা সহজেই বন-জঙ্গলে লুকিয়ে যেত।
যেহেতু বনের গাছ,জঙ্গল গেরিলাদের লুকাতে সাহায্য করছিল এবং বনের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে গেলেই সেটির উপর বনের ভেতর থেকে গেরিলারা আক্রমণ করে অনেক আমেরিকান বিমান, হেলিকপ্টার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল।
তাই আমেরিকানরা ঘন বন জঙ্গল পরিষ্কার করতে মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ "এজেন্ট অরেঞ্জ" এবং "এজেন্ট ব্লু" ব্যবহার করে। (এই পদার্থগুলো ব্যবহারে গাছের পাতা ঝড়ে যেত)।
এতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ১০লক্ষ হেক্টর বনভূমি নষ্ট হয়ে যায় এবং জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে যাবার ফলে আমেরিকার আকাশ পথে আক্রমণের পথ সুগম হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামী গেরিলারা যখন ঘন বনজঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারলো না তখন তারা আরেক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলো। তারা মাটির নিচে সুরঙ্গ খুড়ে সেখানে লুকিয়ে পড়ল।
মাটির নিচে তারা বিভিন্ন ক্যাম্প, বিশ্রামাগার, অস্ত্রের গুদাম স্থাপন করল। এইসব সুরঙ্গ অনেক নিচ অব্দি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রায় ৩০ ফিটের মত গভীরে । ফলে আমেরিকানদের ভিয়েতনামের গেরিলারা আক্রমণ করেই সুরঙ্গে লুকিয়ে যেত এবং অন্য পথ দিয়ে বের হয়ে আমেরিকানদের পেছন থেকে হামলা করতো।গেরিলাদের বিমান থেকে বোমা মেরে নির্মূল করা যাচ্ছিল না। আবার তাদের যুদ্ধের ময়দানেও হারানো অসম্ভব হয়ে পড়চ্ছিল। ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ কৌশলের কাছে আমেরিকান সেনারা বার বার মার খাচ্ছিল।
গুপ্ত বাঙ্কার নির্মাণঃ
ভিয়েতনামীরা সুরুঙ্গের মাথায় খুবই নিচু একধরনের বাঙ্কার নির্মাণ করেছিল। যেগুলোর ফাকা অংশটি এতই নিচু ও সরু ছিল যে কেবল দুই চোখ ও বন্দুকের নলটা বাঙ্কারের বাইরে বের করা যেত। বাইরে থেকে বাঙ্কারের কাছে এসেও এটি সাধারণ চোখে কোন সাপের বাসার মত দেখতে মনে হত। চোরা গুপ্তা হামলার জন্য এটি ছিল একটি মোক্ষম অভিনব উপায়। আমেরিকান সৈন্যদের খুব কাছ থেকে গুলি করলেও আমেরিকান সৈন্যরা বুজে উঠতে পারতো না যে কোথা থেকে গুলি করা হয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা এর আশপাশ দিয়ে হেটে গেলেও অনেক সময় ধরতে পারতো না। যে এই ছোট গর্তটি আসলে একটি ব্যাঙ্কারের মত ব্যবহার করছে ভিয়েতনামের গেরিলারা।
আমেরিকান অস্ত্রের recycling :
ভিয়েতনাম যোদ্ধারা দাতে দাত চেপে আমেরিকানদের সাথে যুদ্ধ করেছে। আমেরিকান সৈন্যদের মত আধুনিক অস্ত্র তাদের ছিল না। অত্যাধুনিক কামান, গোলাবারুদ ছিল উত্তর ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর কাছে কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধ করা গেরিলাদের কাছে এসব পৌছানো সহজ ছিল না। কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলারারা নিজেদের অস্ত্র সংকট মোকাবেলা করেছে চতুরতার সাথে।
তারা আমেরিকান বিস্ফরিত না হওয়া কামান বা বিমানের গোলা, বিধস্ত হেলিকপ্টার এর ক্লাস্টার ব্যবহার করে ছোট ছোট গ্রেনেডে রিসাইলিং করতো। ফলে এই যুদ্ধে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির সেনা ও গেরিলাদের যুদ্ধের অর্থসংকট প্রভাব ফেলতে পারে নি। ভিয়েতনামীরা আমেরিকান বিভিন্ন অস্ত্রের বিভিন্ন টুকরো নিয়ে বাজারে বিক্রি করে নিজেদের সদস্যদের খাবার কিনতো। বিভিন্ন আমেরিকানদের বিমান থেকে ফেলা বিভিন্ন বিস্ফোরক অস্ত্রের repair করে সেই অস্ত্রই আমেরিকানদের উপর ব্যবহার করতো। আমেরিকা এই যুদ্ধে প্রায় ৪০ লক্ষ বোমা আকাশ থেকে ফেলেছিল।
একটি আমেরিকার কামানের গোলা থেকে পাউডার বের করছে একজন ভিয়েতনামী নারী যোদ্ধা।
(সেগুলো দিয়ে গ্রেনেড তৈরী করা হবে।)
ভিয়েতনামের যুদ্ধ বিশ্বকে দেখিয়েছিল কিভাবে আমেরিকার মত সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতাধর দেশকে বুদ্ধি আর সাহসের জোড়ে নাকানিচুবানি খাওয়ানো যায়!!