হিলেল নুয়ের, কানাডায় জন্ম নেওয়া একজন আইনজীবী। জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিক বেড়ে ওঠার সময় পড়াশোনা করেছেন দা হিব্রু ইউনিভর্সিটি অফ জেরুসালেমে। UN Watch এ কর্মরত মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত এই আইনজীবীর 2017 সালের মার্চ মাসে UN Watch এ দেওয়া একটি বক্তব্য সারা বিশ্বের কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তার জিজ্ঞাসার সার-সংক্ষেপ ছিলো, মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত ইহুদীরা আজ কোথায় তা নিয়ে। এক বছর পরে উত্তর হিসেবে উপস্থাপন করেন, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত ইহুদীদের উপর ধর্মীয় সহিংসতা। যদিও তার বক্তব্যের মধ্যে আছে শঠতা। তিনি একপেশিভাবে মুসলিমদের দায়ী করার পাশাপাশি, ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বকে বৈধ করার কূটকৌশল অবলম্বন করেছেন।




প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা মিডিয়াতে ব্যয় করার একটি উদ্দেশ্য হল মানুষের স্বাধীন ভাবনা শক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা। তাই দিন দিন মানুষ নিরপেক্ষ ভাবে আলোচনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। একই সাথে পাশ্চাত্যের মিডিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করবে এমন গণমাধ্যম শক্তি ভিন্নমত পোষণকারীদের নেই। একই সাথে মূলস্রোতের গণমাধ্যমে, সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কেউ আছে কি?

এক যুগে একবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো আমাদের যে করুণা ভিক্ষা দেন, আমাদের তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।





দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, আলবেনিয়ান মুসলিমরা ইহুদীদের প্রতি যে উদারতা দেখিয়েছিলেন, তা আজ এক হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। মিডিয়াগুলো যখন ইহুদী-মুসলিম সংঘাতের ফুৎকার দিয়ে যাচ্ছে, জীবনকে ঝুঁকির সম্মুখীন করে ইহুদিদের জীবন বাঁচানো আলবেনিয়ান মুসলিমদের অবদান কেউ স্মরণ করছেন কি?




দা ক্রিস্টিয়ান সাইন্স মনিটরে, 2011 সালে প্রকাশিত রিপোর্ট এবং নরমেন গ্রেসম্যানের বিখ্যাত আলোকচিত্র প্রদর্শনী "Besa: Muslims Who Saved Jews WWII" থেকে আলবেনিয়দের এই উদারতার ধারণা পাওয়া যায়।




আলবেনিয়ায় ঐতিহ্যগতভাবে প্রচলিত Code Of Besa এর অর্থ, "ওয়াদা রক্ষা করা"। আর এই ওয়াদা রক্ষা করা আলবেনিয়ানদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের। যার ফলস্বরূপ মুসলিম সম্প্রদায় আলবেনিয়ান ইহুদি সম্প্রদায়কে নাৎজিদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। আলবেনিয়ায় ১৪০০ সাল থেকে ঐতিহ্যের অংশ এই বেসা। যুগের পর যুগ ধরে চলমান এই বেসার আওতাভুক্ত নয়, কেবলমাত্র বন্ধু বা পরিজন। আগন্তুকের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, কেউ আলবেনিয়ানদের প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত হলে তার জন্য জীবন দিতে পরোয়া করেন না আলবেনিয়ান মুসলিমরা।


১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাস। ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি হুকুম দেন আলবেনিয়া দখলের। ১৯৪৩ এর সেপ্টেম্বরে ইতালির যুদ্ধ থেকে সটকে পড়ে। একই সাথে মুসোলিনি বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে। হিটলার তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেয়, আলবেনিয়া দখলের মাধ্যমে সাউদার্ন ফ্লাঙ্ক রক্ষা করার জন্য। ১৯৪৩ সালের অগাস্ট মাসে ৬০০০ জার্মান সৈন্য সেখানে অবস্থান নেন। দখলের পরপর শুরু হয় ইহুদি সন্ধান। এলাকাবাসীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ইহুদীদের সম্পর্কে।

কি করেছিলেন তখন আলবেনিয়ার মুসলমানরা?


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে সংরক্ষিত আর্কাইভগুলো অন্ততপক্ষে তাই বলে, একজন ইহুদীকেও আলবেনীয়রা জার্মানদের হাতে তুলে দেয়নি। ১৯৪৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেহেদী বিন ফ্রাসেরি গোপনে বলেছিলেন, "সকল ইহুদিদের সন্তানেরা তোমাদের সন্তানের সাথে ঘুমাবে, তারা তোমাদের পরিবারের সাথে থাকবে, তোমরা যা খাও তাই খাবে।"

ধারণা করা হয় দুই হাজার ইহুদী বেঁচে গিয়েছিলেন আলবেনিয়ান মুসলিমদের সহায়তায়।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরো ইউরোপ, কমিউনিস্টদের ছায়াতলে চলে যায়। ইউরোপের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত আলবেনিয়া বামদের প্রতাপে, হয়ে যায় অনেকটা এক ঘরে। নরম্যান গ্রেসম্যানের অনুসন্ধান এর আগে আলবেনিয়ানদের এই ত্যাগ বিশ্বমিডিয়া আগ্রহ ভরে প্রকাশ করেনি। গ্রেসম্যান সেসকল লোকদের দেখা পেয়েছিলেন যারা ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই ইহুদিরা ইসরাইলে চলে যান।




টবি টাবাচনিক, দি জিউইস ক্রনিক্যালে লিখেছিলেন, গ্রেসম্যানে সেইসকল মানুষকে খুঁজে বের করে সম্মান করতে চেয়েছিলেন, যারা ইহুদিদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন, ব্যক্তির ধর্মীয় অনুশাসন এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল বিচার না করে।

একই সাথে গ্রেসম্যানের বক্তব্য ছিলো, বাঁধাধরা নিয়ম ভেঙে ফেলে, মানবতার সেই শিকড় অনুসন্ধান যা তৈরি হয়েছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে।


শেষ করতে চাই, আলবেনিয়ান রিসেপ হোজার বক্তব্য দিয়ে। হোজার পরিবার আশ্র‌য়প্রার্থী ইহুদি স্থান দিয়েছিলেন নিজ গৃহে। তিনি বলেন,"আমাদের সাথে অবস্থান করা ইহুদীদের সম্পর্কে সবাই জানত। প্রতিবেশী, পুলিশ সবাই। কেবল জানতো না নাৎজিরা। তবে কেউ কোনো কথা বলেনি। এটাই আমাদের সংস্কৃতি, যা আমাদের শিক্ষা দেয়, অতিথিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়। একই সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয় প্রতিবেশীর সাথে।"


আমরা একপেশি অবস্থানে নিন্দা করি, আমরা নিন্দা করে যারা সত্যকে গোপন করে, বিশ্বে ঘৃণার বীজ বপন করে চলেছে। এবং মানুষের স্বাধীন ভাবনার জগতকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সাধুবাদ জানিয়ে, আজকের মত এখানেই বিদায়।


আসাদুজ্জামান খান জিসান
ইতিহাসনামা.কম এর ৩ জন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। হাইবারনেশনে থাকা ভাল্লুকদের প্রতি অসীম ঈর্ষা রয়েছে তার।