সেই বহুকাল আগে সকালের নাস্তা বলতে আটার রুটি, ভাজি, ডিম ইত্যাদিকেই বোঝানো হতো। অতিথি  আসলে সাধারণত: রুটি লুচির সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিবেশন করা হতো। বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি বেকারি আইটেম বাঙালির খাদ্য তালিকায় অনেক পরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই অঞ্চলে তখন বেকারী শিল্পই চালু হয়নি। মোগল ও বৃটিশ আমলে মোগল, পর্তুগিজ ও ইংরেজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। সেই আমলে অধিকাংশ পর্তুগিজ জনগণের বসবাস ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তাদের খাদ্যাভ্যাসের জন্যই প্রায় ২৫০ বছর আগে পূর্ববাংলার চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম বেকারিশিল্পের যাত্রা শুরু হয়।

মোগল আমলের শেষদিকে বেকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী ভারতের বর্ধমান জেলা থেকে চট্টগ্রামে এসে এই বেকারিশিল্পের সূচনা করেন। বর্ধমানে অন্যান্য বেকারী দ্রব্য উৎপন্ন হলেও তখন বিস্কুট তৈরী হতো না। মূলত: পর্তুগিজদের আগ্রহেই চট্টগ্রামে বেকারিশিল্পের আগমন ঘটে। শুরুতে সাধারণ রুটি তৈরি হতো সেসব বেকারিতে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি শুরু হয় পাউরুটি ও কেক। বিস্কুট তৈরি শুরু হয়েছে আরো অনেক পরে। মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষেরা। বিশিষ্ঠ সওদাগর লাল খাঁ সুবেদার ও তাঁর ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কথিত আছে এই লাল খাঁ সুবেদারের পরবর্তী বংশধর আব্দুল গণি সওদাগর পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৭৮ সালে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম বিস্কুট তৈরির প্রচলন ঘটান। এই বিস্কুটের নাম রাখা হয় ‘বেলা বিস্কুট’ যা আজও সারাদেশে সমানভাবে জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের বেলা বিস্কুটের খ্যাতি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই বৃটিশ আমলে চট্টগ্রামের চন্দনপুরা কলেজ রোডে গনি সওদাগরের নাম অনুসারে ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুটের দোকানের নাম রাখা হয়েছিল “গনি বেকারি” যা এখনও চালু আছে। মতান্তরে গবেষকগণ বলে থাকেন, প্রায় ১৫০ বছর আগে এই গণি সওদাগরের বেকারিতেই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বিস্কুট তৈরীর যাত্রা শুরু হয়েছিলো।

বেলা বিস্কুট বেকারি

বেলা বিস্কুটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বিস্কুট তৈরীতে তারা এখনো সেই পুরাতন পদ্ধতিকে অনুসরণ করে থাকে। আধুনিক বেকারির মতো ওভেনে তৈরী না করে বেলা বিস্কুট এখনও মাটির তৈরী তন্দুরে বানানো হয়। তন্দুরে বানালে বিস্কুটের আসল স্বাদ ও গুণগত মান বজায় থাকে। উল্লেখ্য, বর্তমানে অধিকাংশ বেকারি প্রতিষ্ঠানে বিদেশের তৈরী আধুনিক ওভেনে বিস্কুট ছেকা হয়। বেলা বিস্কুট তৈরীর প্রস্তুতি পর্বেও তারা পুরানো ধারাকেই অনুসরণ করে থাকেন। ময়দা, চিনি, তৈল, ডিম ইত্যাদি দিয়ে বিস্কুটের খামি তৈরী ও বিস্কুটকে ফোলানো বা ফাঁপানোর জন্য অন্যরা যেখানে ‘ইস্ট’ বা খাওয়ার সোডা ব্যবহার করে, সেখানে বেলা বিস্কুট তৈরীর সময় এসব ব্যবহার না করে ‘মাওয়া’ মিশানো হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি ভালো পদ্ধতি। যাদের গ্যাষ্টিক বা এ্যাসিডিটি’র সমস্যা আছে তাদের খাওয়ার সোডা বা ইষ্ট মিশ্রিত যে কোনো খাদ্য না খাওয়াই ভালো। তাতে এ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খামি তৈরীর পর, খামিকে বিস্কুটের সাইজে কেটে কেটে তা ফাঁপানোর জন্য ৮ থেকে ১০ ঘন্টা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দেওয়া হয়। অতঃপর কাঁচা বিস্কুট তন্দুরির ভেতর ঢুকিয়ে প্রথমে এক সাইড ছেকা হয় এবং তারপর ওপর সাইড ছেকে বিস্কুট তৈরীর কাজ সম্পন্ন করা হয়। এ কারণে আধুনিক বেকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেলা বিস্কুট তৈরী হতে সময় বেশী লাগে।

বিস্কুট
গণি বেকারির হাত ধরে উপমহাদেশে বেলা বিস্কুট সর্বপ্রথম তৈরী হলেও ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে বিস্কুট তৈরি শুরু হয়। ১৯৩৯- ৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেকারিশিল্পের আরও প্রসার ঘটে চট্টগ্রামে। গণি বেকারি থেকে সে সময় বৃটিশ- ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর সৈনিকদের জন্য বেকারির পণ্য সরবরাহ করা হতো। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে এখনকার ক্রেতারাও বংশ পরম্পরায় বেলা বিস্কুটের গ্রাহক। এ কারণে হয়তো এ দীর্ঘসময় ধরে বেলা বিস্কুটের জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি।

লেখক: এ কে এম শামসুদ্দিন
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা