প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো মাত্র একটি আত্মহত্যর জন্য। কিভাবে? পুরো লেখাটি পড়লে প্রতিটি পাঠকের কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ১৮৪৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরির সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রথম ফ্রাঞ্জ জোসেফ। উত্তরাধিকার সূত্রে অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরির সিংহাসনে বসার অধিকার ছিলো তার একমাত্র ছেলে রুডলফের। ১৮৮১ সালে রুডলফের বিয়ে হয় স্টেফানির সাথে। স্টেফানি ছিলেন বেলজিয়ামের রাজকুমারী। কিন্তু তাদের মাঝে দূরত্ব দেখা দিতে শুরু যখন তাদের একমাত্র সন্তান এলিজাবেথের জন্ম হয়। এমন কি রুডলফ মদ এবং পরনারীর প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পরে।

রুডলফ

১৮৮৮ সালের দিকে, রুডলফের বয়স তখন ৩০। সে মেরি ভেটসেরার নামক ১৭ বছর বয়সী এক নারীর প্রেমে পরে যায়। কিন্তু রুডলফের বাবা অর্থাৎ সে সময়ের অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরির সম্রাট প্রথম ফ্রাঞ্জ জোসেফ এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। তিনি কড়া ভাষায় তার ছেলেকে এই সম্পর্ক থেকে সরে আসতে বলে। বাবার এমন সিদ্ধান্ত রুডলফের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য সে প্রথমে তার প্রেমিকা মেরি ভেটসেরারকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে খুন করে এবং তারপরে সে নিজেই নিজের দেহে গুলি করে আত্মহত্যা করে।

ডেভিড ক্রুসের ‘দ্য ইস্ট– ওয়েস্ট ডাইমেনশন’ বই থেকে রুডলফের আত্মহত্যা এবং আরো কিছু ঘটনার কথা জানা যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন, মেরি যখন জানতে পারেন রুডলফের বাবার এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারছে না, তখন তিনি নিজেও বেশ ভেঙে পড়েন। তারপর রুডলফকে তিনি অনুরোধ করেন সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে শেষবারের মতো শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবার জন্য। সেই আবেদন অগ্রাহ্য করতে পারেন নি রুডলফ। আর এটাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় ভুল।

অবশ্য ডেভিড ক্রুসের ‘দ্য ইস্ট– ওয়েস্ট ডাইমেনশন’ বইয়ের এই কাহিনীযে কতটুকু সত্য তা নিয়ে এখনো অনেক সন্দেহ আছে। শুধু দুজনে তাদের প্রেম চূড়ান্ত পরিণতি পাচ্ছে না দেখে মারা গিয়েছিলেন, এ ব্যাপারেই নিশ্চয়তা দেয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো- এই প্রেমিক জুটির মৃত্যু কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটালো?

আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে অনেক কারন আছে, এই কারণগুলো এতোই জটিল আর এতোই বিশাল যে, এগুলো নিয়ে এখনও ঐতিহাসিকদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে।


রুডলফের মৃত্যুর পর তার বাবার আর কোনো পুত্রসন্তান ছিলোনা যে তাকে সিংহাসনে বসিয়ে রেখে যাবেন। ফলে এরপরে সিংহাসনে আসার কথা ছিলো জোসেফের ছোট ভাই আর্চ ডিউক কার্ল লুডউইগের। বলা হয়ে থাকে, জোসেফের ছোট ভাই আর্চ ডিউক কার্ল লুডউইগের নাকি সিংহাসনে বসার ইচ্ছা ছিলোনা। তিনি নাকি সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করেছিলেন। অনেকই মনে করতেন এটা ছিলো একটা ডাহা মিথ্যা কথা। ১৮৯৬ সালে লুডউইগের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আসার কথা ছিলো তারই বড় ছেলে আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, তখনই আসলে আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড প্রতিপক্ষের টার্গেটে চলে আসেন। ১৯১৪ সালের অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে যে হত্যা করেছিলো সে অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় নাগরিক ছিলো, কিন্ত জাতিতে আবার বসনীয় সার্ব। সে সময় বসনিয়া অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। ধারনা করা হয়, আততায়ী গাভরিলো প্রিন্সিপ নামের ছাত্রটি ছিলেন ‘তরুণ বসনিয়া’ বা ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’ দলের সদস্য। এদলগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল অস্ট্রো- হাঙ্গেরী শাসন থেকে বসনিয়াকে মুক্ত করা। হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে। ফার্দিনান্দের নিহতের খবরে নড়েচড়ে বসে অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি। অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়াকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিলো খুবই গোপনীয়তায় ভরা ও জটিল। ফ্রান্সের সাথে ব্রিটেনের ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে ব্রিটেন প্রথমদিকে জার্মানির সাথে বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। কিন্ত জার্মানি ব্রিটেনের সাথে নৌ- প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। অন্য দিকে ফ্র্যাঙ্কো- প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফরাসিদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। যার ফলে ফরাসিরা রাশিয়ার সাথে মৈত্রী করে। অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরী রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখতো, তাই তারা আবার জার্মানির সাথে মৈত্রী চুক্তি করে। সার্বিয়ার উত্থানের সাথে সাথে স্লাভ জাতীয়তাবাদ জোরদার হয়ে ওঠে। অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরী সার্বিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলার সুযোগ পেয়ে গেলো। কিন্তু সার্বিয়ার মিত্র ছিল রাশিয়া। সেই মিত্রতার জোরে সার্বিয়া হুমকি অগ্রাহ্য করবার সাহস দেখাতে পারে ও সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। বিভিন্ন মৈত্রী চুক্তি, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন পর্যায়ে সত্যের বিভিন্ন বিকৃতি রাষ্ট্রনায়কদের যুদ্ধের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়।

২৮ জুলাই ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরী সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সার্বিয়ার সঙ্গে মিত্রতা থাকার কারনে রাশিয়া এগিয়ে আসে সার্বিয়ার সাহায্যার্থে। এর ঠিক পরদিন রাশিয়া সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরীর সাথে জার্মানির মৈত্রী চুক্তি হয়। তাই তারাও যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ফলে জার্মানিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। রাশিয়ার মিত্র ফ্রান্সই বা বসে থাকবে কেন? এদিক দিয়ে ফ্রান্সও সৈন্য সমাবেশ শুরু করে দেয় জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে। যুবরাজের হত্যার পর, জার্মানি চিন্তা করেছিলো যে, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত, আঞ্চলিক যুদ্ধে তারা বিজয় পেয়ে যাবে। তাই তারা অস্ট্রিয়াকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সার্বিয়ার উপর হামলা করার অনুমতি দিয়ে দেয়। যা ছিলো বিরাট আরেকটি ভুল।

জার্মানি অস্ট্রিয়াকে নজিরবিহীন সমর্থন দেয়ায় ভবিষ্যৎ জার্মান শক্তির সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ফ্রান্স এবং রাশিয়ার তরফ থেকে অনাকাঙ্খিত শত্রুতা ডেকে আনে। রাশিয়া এবং ফ্রান্স এক সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেও জার্মানি তাদের সাথে ভালোই মোকাবেলা করছিলো, কিন্তু ব্রিটেনের চোখে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের তুলনায় একটি নতুন ও শক্তিশালী জার্মানি ছিল বড় হুমকি। তাই তারা পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ও নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষিত করার জন্যই জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ব্রিটেনের মত শক্তিশালি দলের আগমনে জার্মানি ব্যাপক হুমকীর মুখে পরে যায়। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাঝেই রাশিয়া পরাজিত হয়ে যুদ্ধত্যাগ করে। ইতোমধ্যেই ৩ বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার জার্মান সেনাবাহিনী অদূরদর্শীতার পরিচয় দেয় আমেরিকান জাহাজে আক্রমণ করে। জার্মান নৌ-বাহিনীর আক্রমণ ঘুমন্ত দৈত্য যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে ডেকে এনে চুড়ান্ত জার্মান পরাজয় নিশ্চিত করে। (এমন স্ট্র্যাটেজিক ভুল জার্মানদের দ্বারাই সম্ভব তা আবারো প্রমাণিত হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে)

এছাড়া শিল্পন্নোয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে নব্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা জার্মানির উত্থান ফ্রান্স, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যের জন্য নিশ্চিত হুমকি ছিল এবং এটা ঠেকানোর জন্যই ফ্রান্স-রাশিয়া-ব্রিটেন এবং সবশেষে যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়। এবং ৪ বছর ধরে চলা ব্যাপক ক্ষয়- ক্ষতি নিশ্চিতের পর হাবসবুর্গ (অস্ট্রিয়ান), অটোমান (তুর্কিশ) এবং রোমানভ (রাশিয়ান) সাম্রাজ্যের মতো ৩টি শতাব্দী প্রাচীন প্রবল আধিপত্য বিস্তারকারী সাম্রাজ্যের পতন চূড়ান্ত হয়। এবং এরই সাথে নিজেদের আড়াল করার নীতি থেকে বের হয়ে এসে যুদ্ধের শেষ দিকে যোগ দিয়েই মূল নায়কের আসনে বসে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উইলসনের নেতৃত্ব শুরু হয় দুনিয়ায় নতুন ধরনের রাজনীতি। কিন্তু যুদ্ধের পর পর সবাই যখন ভাবছিলো যে এমন মানবসৃষ্ট দুর্যোগের আর পূনরাবৃত্তি ঘটবে না, তখনই তৎকালীন বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিগুলো এমন সব কান্ড করতে থাকে যা সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ এবং পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিলো।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পেছনে আরও অনেকগুলো কারণ থাকলেও শুধু ফার্ডিনান্ডের মৃত্যুই যেন সব কারণকে পেছনে ফেলে মুখ্য হয়ে উঠেছে। রুডলফ ক্ষমতায় বসলে ফার্ডিনান্ড কোনোদিন ক্ষমতায় বসতো না। তাই রুডলফের আত্নহত্যাকেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

আরো পড়ুন
  1. আর্মেনীয় গণহত্যা: অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক জঘন্য মিথ্যাচার
  2. আটলান্টিস: পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া এক রহস্যময় সভ্যতা
  3. মুসলমানদের হাতেই বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়
ইউসুফ হাসান আদিত্য
অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া ইউসুফ হাসান আদিত্য ঝামেলা পাকাতে উস্তাদ। আবিষ্কার আর বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে তার রয়েছে অসীম আগ্রহ।