স্বাধীনতার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোয় অতন্দ্র নেতৃত্ব দিয়ে আসছে আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ইতিহাসের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে সাধারণ সিভিলিয়ানদের জীবন মরণ সংকটে নানা ঝুঁকি সত্ত্বেও দায়িত্ব পালনের অনন্য নজিরও আছে আমাদের প্রফেশনাল এই বাহিনীটির। তবে দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, শ্রমিক বান্ধব কর্ম পরিবেশ না থাকায় বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে প্রতিবছর অনেক দূর্ঘটনা ঘটে এবং অধিকাংশ দূর্ঘটনাতেই সেনাবাহিনীকে রেসকিউ অপারেশনে অংশ নিতে হয়েছে। নিচে ২০০০ থেকে ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের মর্মান্তিক শ্রমিক দূর্ঘটনাগুলোর তালিকা দেয়া হলো:



নভেম্বর ২০০০ - ঢাকার চৌধুরী নিট ওয়্যার কারখানায় আগুন, নিহত ৪৮
.

আগস্ট ২০০১ - মিরপুরের ম্যাক্রো সোয়েটারের আগুন, নিহত ২৪
.

জানুয়ারী ২০০৫ - নারায়ণগঞ্জের শান নিটিং অ্যান্ড প্রসেসিং লিমিটেডে আগুন, নিহত ২৮
.

এপ্রিল ২০০৫ - আশুলিয়ায় স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধস, নিহত ৬৪  
.

ফেব্রুয়ারি ২০০৬ - চট্টগ্রামে কে.টি.এস টেক্সটাইল মিলে আগুন, নিহত ৬৫
.

ফেব্রুয়ারি ২০০৬ - তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স টেক্সটাইলের ভবন ধস, নিহত ২১
.

ফেব্রুয়ারী ২০১০ - গাজীপুরের গারিব & গারিব সোয়েটার ফ্যাক্টরীতে আগুন, নিহত ২১
.

ডিসেম্বর ২০১০ -  আশুলিয়ার হামীম গ্রুপের দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যারে আগুন, নিহত ২৯
.

নভেম্বর ২০১২ - আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকান্ড, নিহত ১১২
.

এপ্রিল ২০১৩ - সাভারের রানা প্লাজা ধস, নিহত ১,১৩৮
.

সেপ্টেম্বর ২০১৬ - টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, নিহত ৩৫  
.

জুলাই ২০১৭ - গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, নিহত ১৩
.

জুলাই ২০২১ - নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে আগুন, নিহত ৫২
.
 

দূর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা:

সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এই প্রতিটি দূর্ঘটনা পরবর্তী জরুরী মুহূর্তে বেসামরিক প্রশাসনের পাশাপাশি সক্রিয় অবস্থানে ছিলো আমাদের সেনাবাহিনী। ২০০৬ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প নগরীতে কে.টি.এস গার্মেন্টসের ভয়াবহে অগ্নিকান্ডে ৬৫ জন প্রাণ হারান। সেসময় সেনাবাহিনী সেখানে জরুরী উদ্ধার কাজে বেসামরিক প্রশাসনকে অত্যন্ত কার্যকর সহায়তা প্রদান করেছিলো। ২০০৬ সালেই ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় চারতলা ফিনিক্স গার্মেন্টস ভবন ধসে পড়লে আটকা পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার ও ধবংশাবশেষ অপসারণ কাজে সেনাবাহিনী সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে ২১ জনের মৃতদেহ এবং ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
 



সাভারের রানা প্লাজা ধস ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কারখানা দূর্ঘটনা। যে সময় ধসে পড়া নয়তলা ভবনটির গোটা উদ্ধারতৎপরতায় নেতৃত্ব দিয়েছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অনেক টেকনিকাল চ্যালেঞ্জ এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুকে বাজি রেখে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রানা প্লাজা থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিলো মোট ২ হাজার ৪৩৮ জনকে। রানা প্লাজার উদ্ধার অপারেশনে নিয়োজিত ছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন এবং এনার্জি প্যাকের সেনাকর্মচারী ও কর্মকর্তারা। রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার হওয়া আহতদের কেউ যদি কখনো সিএমএইচে চিকিৎসা নিতে চায়, সে সুযোগও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে খোলা রাখা হয়েছে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য যে, রানা প্লাজায় সেনাবাহিনীর সাথে উদ্ধার কাজের সময় দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান স্বেচ্ছাসেবক এজাজ উদ্দিন কায়কোবাদ। উন্নত চিকিৎসার জন্য এই মহান ব্যক্তিটিকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছিলো সরকার।  

আলোচনা শেষ করা যাক কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ দিয়ে। বয়লার বিস্ফোরণ সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই তারা কল্পনাও করতে পারবেন না কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই দূর্ঘটনাটি। অধিকাংশ সময়ই বয়লার বিস্ফোরণের পরে অকুস্থলে অগ্নিকান্ড ঘটে যায়। পুরো বিষয়টিকে অপেশাদার দৃষ্টিকোন থেকে কোনো বড় বোমা হামলা বললে ভুল হবে না। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমাদের দেশে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনাও বিরল নয়। বয়লার বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া অনেকটা ভূমিকম্পের মতো হয়ে যায় বিধায় ভবনধসের ঝুঁকি থাকে। টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের পরে ৫ তালা একটি ভবন ধসে পড়ে! এমন জরুরী পরিস্থিতিতে বেসামরিক সংস্থাদের অত্যন্ত কার্যকরী পরামর্শ এবং সহযোগিতা প্রদান করতে পারে সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার এবং সৈন্যরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বয়লার বিস্ফোরণের পরে তাই সেনাবাহিনীকে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়।

কিছু মর্মান্তিক বেসামরিক গল্প দিয়ে লেখাটির ইতি টানতে চাই। দমকল, পুলিশ বা সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আমাদের মতো অনেক সাধারণ সিভিলিয়ানও দেশবাসীর জীবন বাঁচানোর প্রশ্নে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়ে থাকেন। এটি অত্যন্ত মহান একটি কাজ। তবে এর জন্য অনেক সাধারণ মানুষকে প্রতিবছর চড়া মূল্য দিতে হয়। সামরিক বেসামরিক বাহিনীর ব্যক্তিরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাকরি করে মানসিক ভাবে অনেক কঠোর এবং অভিজ্ঞ হয়ে পড়েন।  কিন্তু সাধারণ মানুষদের অনেকেই বিপদে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে গিয়ে এমন কিছু স্নায়ু অবশ করে দেয়ার মতো দৃশ্য দেখেন, যাতে করে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচুর ক্ষতি হয়। সাভারে উদ্ধার কাজে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়া অনেকেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ ঘুমের মধ্যে শুধু লাশ দেখেন, কেউ রাতে ঘুমাতে পারেন না, হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই জায়গায় লাশ আছে, ব্যাগ আনেন, কাপড় আনেন।’ অনেকে উদ্ধারকার্য করতে গিয়ে নিজের হাতে মানুষের জীবিত অথবা মৃতদেহকে করাত দিয়ে কেটেছেন। এখন যখন তারা মানসিক যন্ত্রনায় আছেন, কেউ তাদের খোঁজও নেয় না..। হতদরিদ্র দেশে জন্ম নেয়ার অনেকগুলো দূর্ভাগ্যের একটি হয়তো এই যে, অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে গেলে নিজের জীবনটাকেই আগে নিজ হাতে ধ্বংস করতে হয়!
আশরাফুল আলম প্রান্ত
ইতিহাসনামা.কম এর তিনজন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন। অতিরিক্ত স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সময় অপচয় করা তার মুদ্রা দোষ।