দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রথম বড় ধরনের যুদ্ধ হয় পূর্ব এশিয়ার দেশ কোরিয়ায়। কোরিয়ার উত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সরকার ও দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী সরকার গঠনের কারণে দুই কোরিয়ার মধ্যে বিশাল রাজনীতিক বিভাজন দেখা দেয়। যা প্রাথমিকভাবে যুদ্ধের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এক সময় যুক্ত কোরিয়া চীন ও জাপানের কলোনি ছিল। ১৮৯৫ সালে চীন কোরিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯০৪- ১৯০৫ সালে রাশিয়া- জাপান যুদ্ধে জাপান জয়ী হওয়ায় কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া উপদ্বীপকে ৩৮তম সমান্তরাল রেখায় ভাগ করে। এ সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী দক্ষিণ অংশ ও সোভিয়েত বাহিনী উত্তর অংশ নিজেদের অধিকারে আনে। এ সময় সোভিয়েত সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে কোরিয়ার উত্তর অংশে একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার ও দক্ষিণ অংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৬ সালে উত্তর অংশে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের আহবানে কোরিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পরে দেখা যায় নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতে হয়েছে। এরইমধ্যে ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে।
   
North-Korea-map

দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার মাসখানেক আগে থেকেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং দুই কোরিয়ার সীমানায় বিচ্ছিন্ন লড়াই সংঘটিত হতে থাকে। তবে ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে জাতিসংঘ দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলো।

পরবর্তীতে জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং চীনা সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করে‌। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনা ও উত্তর কোরীয় উভয় বাহিনীকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে থাকে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। উল্লেখ্য জাতিসংঘ বাহিনীর ৮৮ শতাংশ সৈন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিলো। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দু'বছর পর, ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এভাবেই শেষ হয় কোরীয় যুদ্ধ।

তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও দুই দেশের ক্ষেত্রে কূটনীতিক ও সামরিক তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। অনুমান করা হয়, ২৫ লাখের উপরে বেসামরিক মানুষ এই যুদ্ধের ফলে হতাহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি হবার ঠিক এক মাসের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং উত্তর কোরিয়াকেও দেখা যায় চীনের সাথে একটি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক চুক্তি করতে।

কোরিয়ার এই যুদ্ধ মার্কিন- সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি প্রথম বিশ্বের কাছে বড় আকারে প্রকাশ করে। পরবর্তীতে যা সোভিয়েত- মার্কিন পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা পর্যন্ত জাগিয়েছিলো। একারণে স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসে কোরিয়া যুদ্ধকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।