১। সামন্তবাদ: ফ্রান্সে প্রচলিত সামন্তবাদ গোটা সমাজকে তিন স্তরে ভাগ করে ফেলে। যাদের আমরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এস্টেট নামে চিনি। প্রথম এস্টেটে ছিলো রোমান ক্যাথলিক যাজকেরা, দ্বিতীয়তে ফ্রান্সের রাজকীয় পরিবারসমূহ এবং বাকি সবাই ছিলেন তৃতীয় এস্টেটে। এই বাকিদের মধ্যে ব্যবসায়ী শ্রেণী, আইনবিদ, দিন মজুর থেকে ভুমিদাস সকলেই অবস্থান করতেন। এই শ্রেণী সমস্যা দ্রুত সামাজিক মর্যাদা এবং ক্ষমতার প্রশ্নে একটি সংকটে রুপ নেয়। কেননা প্রথম এবং দ্বিতীয় এস্টেট, তৃতীয় এস্টেটের মানুষদের সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতেন। উল্লেখ্য যে মোট জনসংখ্যার ৯৮% অবস্থা করতেন এই তৃতীয় এস্টেটে।

২। অন্যায্য কর ব্যবস্থা: ফ্রান্সের প্রথম এস্টেট মোট ভূমির ১০% এর মালিক ছিলো এবং তারা কোনো কর পরিশোধ না করে বরং তৃতীয় এস্টেট থেকে বিপুল কর নিতেন। দ্বিতীয় এস্টেটেরও (মোট ভূমির ২৫% এর মালিক) অনেক কর মওকুফের সুবিধা ছিলো। তবে সব করের বোঝা চাপানো হতো তৃতীয় এস্টেটের ওপর। অনেক অন্যায় অতিরিক্ত কর, ফ্রান্সের অধিকাংশ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলো।

৩। বুর্জোয়াদের উত্থান: তৃতীয় এস্টেটের অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিবর্গদের বুর্জোয়া বলা হতো। বুর্জোয়া কথাটির আক্ষরিক অর্থ শহুরে লোক। তৎকালীন সময়ে এই ধনী বুর্জোয়াদেরও যথাযথ সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হতো। তারা তাদের সম্পদ ও বৈভবের বিনিময়ে সামাজিক মর্যাদা ও তৎকালীন ক্ষমতা কাঠামোতে জোড়ালোভাবে অংশ নেয়ার জন্য অনেক উৎসাহিত ছিলেন। তবে সামন্তবাদের সামাজিক স্তরায়নের কারণে তাদের পক্ষে করের নিপীড়ন ও অন্যান্য বৈষম্য ভোগের বিকল্প ছিলো না। একারণে পরবর্তীতে ফরাসি সামন্ততন্ত্র অবসানের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করেন।

৪। আলোকময় চিন্তকদের প্রভাব: আলোকময়তা বা enlightenment এর প্রাণ কেন্দ্র ছিলো ফ্রান্স। এসময় লক, মন্টেস্কু, রুশোর মতো বিখ্যাত চিন্তকদের লেখনী এবং যুক্তির দ্বারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধারণাসমূহ বিশাল ঝাঁকুনি খায়। এর মধ্যে ছিলো- রাজ ও সামন্তবাদের চূড়ান্ত ক্ষমতাকে মানববাদী যুক্তির আলোকে প্রশ্ন করা; আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র এবং নাগরিকদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধার প্রশ্ন তোলা, বিদ্যমান এস্টেট বা সামাজিক স্তরায়নকে যুক্তির আলোকে খারিজ করা, রাষ্ট্র যন্ত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রসঙ্গ, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের দৌরাত্নের অসারতাসহ ইত্যাদি।

৫। যুদ্ধে জর্জরিত দূর্বল অর্থনীতি: রাজতন্ত্রের শাসনে তৎকালীন ফ্রান্স পুরোনো শত্রু ব্রিটেনের সাথে অনেকগুলো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, যেখানে তাদের প্রাথমিক পরাজয় হয়। পরে ফ্রান্সের সাহায্যে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা মুক্ত হয়, তবে এতে ফ্রান্সের লাভ হয় খুবই কম। বিশাল সাম্রাজ্য ও এর সেনাবাহিনী চালাতে গিয়ে এই যুদ্ধের প্রভাব পরে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে। যার শেষ চাপ গিয়ে পরে- ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের পকেট ও তাদের জীবনযাত্রায়।

। এই তালিকায় আরো যোগ হতে পারে ফ্রান্সের একটি আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের পরে আসা রুক্ষ শীতকালে, ফসলের ক্ষতি হওয়া যা কৃষক বিদ্রোহের দিকে মোড় নেয়। কৃষকদের সম্মিলিতভাবে শস্যের দাম বাড়িয়ে রুটির দাম বাড়িয়ে দেয়া, যাতে গণ মানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। দেশ পরিচালনায় পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুইয়ের অদক্ষতা ও দেশের ক্রান্তি লগ্নেও রাজপরিবারের ভোগবিলাসের লাগাম না টানা। এসবেরই চূড়ান্ত ফলাফল, ফরাসি বিপ্লব। যা ইউরোপসহ পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিশাল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।