মক্কার গ্রেট মসজিদ, আল-মসজিদ আল-হারাম, যাকে পবিত্র মসজিদও বলা হয় বা মুসলিমদের জন্য সৌদি আরবের মক্কার মসজিদ, যা ইসলামের পবিত্রতম ঘর কাবাকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং মুসলিমদের হজ্জের জন্য পবিত্র স্থান হলো মসজিদ আল হারাম। হজ এবং ওমরাহ পালনের জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মুসলিম সেখানে যান।


হাজরে আসওয়াদ

মসজিদ আল হারাম সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের হেজাজে কাবা শরিফকে ঘিরে অবস্থিত। আল্লাহ, ইব্রাহিম আঃ কে ঠিক সেই জায়গাটি দেখিয়েছিলেন যা পূর্বে আদম আঃ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যা জমজম কূপের খুব কাছে, যেখানে ইব্রাহিম আঃ এবং ইসমাইল আঃ কাবা শরিফ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এরপর সেখানে বেহেশতের কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) স্থাপন করা হয়, যা নিকটবর্তী পাহাড় 'আবু কুবাইসে' ছিলো।


৭ম শতকের দিকের মসজিদের একটি ছবি

ইব্রাহিম আঃ মক্কায় কাবা নির্মান করেন, এবং ফলস্বরূপ একে মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হিসেবে দেখা হয় যা অতীত থেকে বিদ্যমান আছে। অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে, ইসলাম ৭ম শতাব্দীতে মুহাম্মদ সাঃ এর জীবদ্দশায় শুরু হয়েছিল এবং সে হিসেবে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় মহানবী ও সাহাবাদের নির্মিত মসজিদটি হবে ইসলামের প্রথম মসজিদ। এক্ষেত্রে অনেকে সাহাবাদের মসজিদ বা 'কুবা মসজিদ'কে ইসলামের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম মসজিদ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।


আবদ আল-মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে ৬৯২ সালে মসজিদ আল হারামের প্রথম বড় সংস্কার করা হয়। এই সংস্কারের আগে, মসজিদটি একটি ছোট খোলা জায়গা ছিলো যার কেন্দ্রে কাবাঘর ছিলো। ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে, মসজিদের পুরানো কাঠের স্তম্ভগুলিকে মার্বেল কলাম দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয় এবং আল-ওয়ালিদ এর নির্দেশে একটি মিনার সংযোজনের সাথে নামাজ ঘরের মিনারগুলি উভয় দিকে প্রসারিত করা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের প্রসার এবং হজ্জযাত্রীদের আগমনের জন্য মসজিদটির মধ্যে আরো সংস্কার ও তিনটি মিনার যোগ করা হয়।


অটোমান সাম্রাজ্যের সময়, ১৫৭০ সালে, সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের নির্দেশে মসজিদটির পুনঃসংস্কার করা হয়। তখন মসজিদটির পুরো সংস্কারের নকশা করেন প্রকৌশলী মিমার সিনান। এর মাধ্যমে সমতল ছাদকে অভ্যন্তরীণভাবে ক্যালিগ্রাফি দ্বারা সজ্জিত গম্বুজগুলি এবং নতুন কলাম স্থাপন করার মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা বর্তমানে মসজিদের প্রাচীনতম স্থাপত্যের চিহ্ন হিসেবে স্বীকৃত।


১৯৬০ সালের দিকেকার মসজিদ

সৌদি রাজাদের অধীনে প্রথম বড় সংস্কার করা হয় ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে। এই সংস্কারে, আরও চারটি মিনার যুক্ত করা হয়, ছাদটি সংস্কার করা হয় এবং মেঝেতে পাথর ও মার্বেল বসানো হয়। এই সংস্কারের সময় অটোম্যানদের দ্বারা নির্মিত অনেক ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়।

মিনার

বাদশাহ ফাহদের অধীনে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ এর মধ্যে আবার সংস্কার করা হয় মসজিদটি। মসজিদের আশেপাশে নামাজ আদায়ের জায়গা বাড়ানো হয় এবং ১৮ টি গেট বসানো হয় যার প্রতিটি গেটে তিনটি গম্বুজ এবং প্রায় ৫০০ টি মার্বেল কলাম স্থাপন করা হয়। অন্যান্য আধুনিক উন্নয়নের মাঝে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এসকেলেটর এবং একটি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়।

২০০৮ সালে, বাদশাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আজিজের অধীনে সৌদি সরকার মসজিদের একটি সম্প্রসারণ করার ঘোষণা দেয়। যার মধ্য দিয়ে মসজিদের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে ৩২০০০০০ বর্গফুট জায়গা বৃদ্ধি করা হয়। এ সম্প্রসারনের জন্য ৪০ বিলিয়ন রিয়াল বরাদ্দ করা হয়েছিলো। কমপ্লেক্সের উত্তর দিকে একটি বহুতল ভবন, নতুন সিঁড়ি এবং টানেল, বাদশাহ আবদুল্লাহর নামে একটি গেট এবং দুটি মিনার তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে মিনারের মোট সংখ্যা হয় এগারো। কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণ এলাকা (মাতাফ) প্রসারিত করা হয় এবং সমস্ত বন্ধ স্থান শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে মসজিদটির মুসল্লি ধারণক্ষমতা প্রায় ২৫ লক্ষ। ২০১২ সালে, আবরাজ আল বাইত কমপ্লেক্সটির সাথে ৬০১ মিটার লম্বা মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ারের কাজ শেষ হয়।


কিং আব্দুল আজিজ গেট


মসজিদটির বর্তমান আয়তন ৩৫৬৮০০ বর্গমিটার, হিসেব করলে যা প্রায় ৮৮ একর। মসজিদটিতে ৯ টি মিনার রয়েছে যাদের উচ্চতা ৮৯ মিটার বা ২৯২ ফুট। এছাড়াও রয়েছে ২১০ টি গেট, যার মধ্যে ৫ টি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, এর মধ্যে কিং আব্দুল আজিজ গেট, বাব-ই-আজাদ গেট, বাব-ই-বিলাল গেট অন্যতম।


আবরাজ আল বাইত


মসজিদ আল-হারাম অনেক সুন্দর একটি স্থাপনা। সমগ্র দৃশ্যপটটি দেখার মত একটি দৃশ্য। স্তম্ভের মাঝে নামাজরত থাকা অবস্থায় যেন আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করতে পারা যায়। কথিত আছে, এই মসজিদটি কখনো ঘুমায় না। লক্ষ লক্ষ মুসলমান সেখানে যায় অনুতপ্ত হতে, ক্ষমা প্রার্থনা করতে এবং সর্বশক্তিমানের প্রশংসা করতে। মসজিদের মাঝখানে পবিত্র কাবা রয়েছে যা একবার দেখার জন্য অসংখ্য মুসলিম সারা জীবন অপেক্ষা করেন। তাছাড়া, কাবা বা আল্লাহর ঘরকে ঘিরে, লোকেরা তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করে যা হজ এবং ওমরাহ পালনের একটি বিশেষ অংশ।

একনজরে মসজিদ আল হারামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ:

পবিত্র কাবা: একটি ঘনক আকৃতির কাঠামো, যা মসজিদের কেন্দ্রে অবস্থিত। এই ঘরের দিকে ফিরেই পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমরা তাদের নামাজ আদায় করেন।

কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ): পবিত্র কাবার পূর্ব কোণে অবস্থিত।

ইব্রাহিম'স স্টেশন: কাবার পাশে অবস্থিত একটি শিলাপাথর, যার মধ্যে ইব্রাহিম আঃ এর পায়ের ছাপ আছে।

সাফা মারওয়া: মসজিদের অভ্যন্তরে অবস্থিত দুটি পাহাড়ের মাঝে, ইব্রাহিম (সাঃ) এর স্ত্রী হাজেরা তার শিশু পুত্রের জন্য পানির সন্ধানে ছুটে যান। এই ঘটনাকে হজের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে স্মরণ করা হয়।

জমজম কূপ: যেখানে অবিরাম পানির প্রবাহ রয়েছে, বিবি হাজেরা কোন পানি খুঁজে না পেয়ে এখানে এসে দেখেন অলৌকিকভাবে পানি উপস্থিত হয়েছে।

Source: Wikipedia,Mecca.Net,ZamZam.com,wikiwand

আনাস রোহান
ইতিহাসনাম.কম এর তিনজন সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজন।বিক্ষিপ্ত মনের অধিকারী।