বর্তমানে দেশে হত্যা নির্যাতন ধর্ষণ কোন নতুন বিষয় নয়। মানুষের নৈতিক পদস্থলনের দরুন এখন এসব ঘটনা গা সওয়া হয়ে গেছে।আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও এসব চিন্তা করা যেতো না।তবুও সে সময় এমন কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যা সমগ্র দেশকে নাড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো ১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি ঘটে যাওয়া নীহার বানু হত্যাকাণ্ড।সেদিন নীহার বানুর উপর এভাবেই ঝাপিয়ে পড়েছিল মানুষরূপী শকুনের দল যারা কিনা তার‌ই সহপাঠী।স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মাথায় ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল মানুষের বিবেককে।

তিন ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন নীহার বানু। বাবা শফিকুর রহমান একাত্তরে শহীদ হন। সেই সাথে দুর্ভোগ আর অনিশ্চয়তার মাঝে মাকে নিয়েই তাঁদের দিন চলতে থাকে। একটা সময় সে খরা তারা কিছুটা কাটিয়ে উঠে। বড় বোন রাজশাহী মেডিকেলে এবং নীহারবানু ভর্তি হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাস্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।

নীহার বানু ছিলেন রূপে গুণে অনিন্দ্য সুন্দরী। সেই সাথে প্রাণোচ্ছ্বল ও মিশুক। মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করে ফেলতেন। হয়তো সেটাই তার জন্য পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক‌ই বর্ষে নীহার বানুর সহপাঠী ছিল আহমেদ হোসেন বাবু। ক্লাসের বিভিন্ন নোট আনা নেওয়ার সুবাদে নীহারের সাথে বাবুর সখ্যতা গড়ে উঠে। ধীরে ধীরে বাবুর নীহারদের বাসায় আনাগোনা বেড়ে যায়। এমনকি নীহারের মাও বাবুকে তাদের পরিবারের একজন ভাবতে শুরু করেন। সেই জেরে একদিন বাবু নীহারের একটি ছবি নেয়। কিন্তু নীহার জানতো না এই বাবুর এই ভালোমানুষীর আড়ালে বাসা বেধে ছিল ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মা।

সরলমনা নীহার না জানলেও ন‌ওয়াব আবদুল লতিফ হলের সবাই জানতো বাবু কেমন মানুষ। তাকে নিয়ে বিভিন্ন কানাঘুষা চলতো। যেমন পরীক্ষার আগে বাবুর প্রশ্ন পাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের সাথে খাতির প্রভৃতি নিয়ে বাবু ছিল বিতর্কিত। সে নীহার বানুকে ক্লাসের সবাইকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিতো। নীহার এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাবু অস্বীকার করে। বাবু নামায না পড়লেও সারাদিন পকেটে নূরানী নামায শিক্ষার ব‌ই সাথে রাখতো। নীহার বাবুর কোন কথা অবিশ্বাস করলে বাবু নামায শিক্ষার ব‌ই নিয়ে ছুঁয়ে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে চাইতো। আর নীহার‌ও সরল মনে বাবুকে বিশ্বাস করে ফেলতো।

নীহার বাবুকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখলেও বাবু কখনোই নীহারকে বোনের দৃষ্টিতে দেখেনি। সে প্রায়‌ই নীহারকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতে তাদের এই ভাই বোনের সম্পর্ককে অন্য কোন সম্পর্কে রূপ দেয়া যায় কিনা। কিন্তু শেষ মেষ ব্যর্থ হয়ে বাবু ক্ষমা‌ও চেয়ে নিতো। এমন‌ই এক সময় নীহারের বিয়ে ঠিক হয়েছে ন‌ওগার এক ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে। বাবু এই কথা জানতে পেরে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।নীহারকে সে কিছুতেই আরেকজনের হতে দিবে না। এজন্য বাবু ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নেয়।

যেহেতু নীহার বানু বাবুকে সরলমনে বিশ্বাস করতো সেটাকেই কাজে লাগায় বাবু। তাকে সহযোগিতা করে সহপাঠী এনামুল, মিন্টু ও সেতুসহ মোট ছয়জন। তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাবু এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াতের কথা বলে নীহারকে মীনা মঞ্জিলে নিয়ে আসবে। পরে তারা নীহারকে বাবুকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিবে যদি নীহার না মানে তবে তাকে চিরতরে হত্যা করা হবে।

১৯৭৬ সালে ২৭ জানুয়ারি। নীহার বানু তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী। ক্লাস শেষে তার বান্ধবীরা নীহার বানুকে বাবুর সাথে কথা বলতে দেখে। কিন্তু বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও নীহার সেদিন বাসায় ফেরেনি। দেখতে দেখতে আরো তিনদিন পার হয়ে যায়।নীহারের পরিবার থানা মিসিং কেস করে। যেহেতু নীহারকে শেষ বারের মত বাবুর সাথে দেখা গিয়েছিল সেহেতু সন্দেহের বীজটা বাবুর দিকে পড়ে। কিন্তু বাবু ততদিনে সাঙ্গপাঙ্গ সহ গায়েব।

এদিকে নিখোঁজের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও নীহারের খোঁজ মেলেনি। কিন্তু পুলিশ সন্দেহভাজনদের একজন এনামুল বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে। তার জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য যার জন্য কেউই তৈরি ছিল না। কী হয়েছিল ২৭ জানুয়ারি?

প্ল্যানিং মতো বাবু নীহার বানুকে মীনা মঞ্জিলে নিয়ে আসে। দীর্ঘ সময়ে সেখানে মানুষের আনাগোনা ছিল না তাই কাকপক্ষীও টের পাবে না। নীহার বানু বুঝে উঠতে পারে না কি ঘটছে। ততক্ষণে বাবু দরজা বন্ধ করে দেয়। বাবু ও তার বন্ধু বান্ধব নীহারকে ঘেরাও করে। নীহার ততক্ষণে সব বুঝে যায় কিন্তু খুব দেরি হয়ে গেছে। বাবু নীহারকে এই মুহূর্তে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেয়। নীহার প্রত্যাখ্যান করলে বাবু জোর করতে শুরু করে। একপর্যায়ে নীহারের ওড়নার আঁচল দিয়ে নীহারের গলায় চেপে ধরে জোর করতে শুরু করে বাবু। নীহার তবুও প্রত্যাখান করে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নীহার শুধু একটা কথাই বলেছিল,"না।"


নীহার বানু হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা পলাতক আহমেদ হোসেন বাবু

নীহারের লাশকে মীনা মঞ্জিলের ফ্লোর ফুড়ে পুতে ফেলা হয় এবং সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করে দেয়া হয়। এসমস্ত ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল মীনা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার রুহুল আমিন ফেতু। বাবু তাকে বলে এসব ঘটনা কেউ জানলে তাকে নীহারের মতো পুঁতে ফেলা হবে। নিমিষেই মীনা মঞ্জিল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

১৯ মে ১৯৭৬। এনামুলের স্টেটমেন্ট মোতাবেক পুলিশ মীনা মঞ্জিলের ঢালাই ভেঙে নীহার বানুর কঙ্কাল উদ্ধার করে। একসময়ের অনিন্দ্য সুন্দরী নীহার বানু অযত্মে কঙ্কালসার হয়ে এতদিন পড়ে ছিল লাশ হয়ে। নীহার বানুর অকাল মৃত্যুতে তাঁর পরিবারে নেমে আসে নতুন দুর্যোগ। মামলার তদন্ত পুলিশ থেকে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়। সমগ্র দেশ নীহার বানুর সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে ফুসে উঠে আপামর জনসাধারণ ও গণমাধ্যম। মামলার তদারকি করেন ড.গোলাম সাকলাইন।

দেখতে দেখতে চলে আসে ১২ জুন ১৯৭৯ সাল। সামরিক আদালতে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ ও ১৬৪ ধারা মোতাবেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী নীহার বানুকে জোর করে অনৈতিক প্রস্তাব ও নৃশংসভাবে হত্যা করার অপরাধে হত্যার মূল হোতা এনামুল হক বাবুর অনুপস্থিতিতে বাবু ও শহীদুল ইসলাম মিলুর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। সেই সাথে অভিযুক্ত মিন্টু ও এনামুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আর হত্যা সহযোগিতা করার জন্য মীনা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার রুহুল আমিন ফেতুকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়।

পত্রিকার প্রতিবেদন

নীহার বানুর পরিবার সেদিন সুষ্ঠু বিচার পেলেও ফিরে আসেনি অনিন্দ্য সুন্দরী নীহার বানু। কেউ জানতো না স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর তাঁকেও ফিরে যেতে হবে তাঁর বাবার কাছে। স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মাথায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। এই ঘটনাকে সবার সামনে আনতে সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক ও পরবর্তীতে স্টাফ রিপোর্টার আহমেদ শফিউদ্দিন। নীহার বানুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পারি তা হলো একটা মানুষকে ভালোভাবে না জেনে তাকে সরলমনে বিশ্বাসের পরিণতি সবসময় ভালো হয় না। সেই সাথে মানুষের সাধুচরিতের আড়ালে কখনো লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর পিশাচ যা সম্পর্কে আমরা অবগত ন‌ই। নীহার তাঁর সুষ্ঠু বিচার পেলেও আজ‌ও তার মতো অনেক ভিক্টিম বিচারহীনতার দরুন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ফলশ্রুতিতে দেশের ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো নিকৃষ্ট ব্যাধি সমাজে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব প্রতিরোধে আমাদের জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং এসবের সাথে জড়িত পিশাচদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা আশা করতে পারি অবক্ষয়মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার।

______________________________________
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইতিহাসনামা পরিবারের ফেসবুক গ্রুপে (১ অক্টোবর, ২০২১)। লেখাটি প্রকাশের সাথে সাথে আমরা জানতে পারি, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটির অনুসন্ধানে থাকা সাংবাদিক, জনাব আহমেদ শফিউদ্দিনের একজন পরিজন আমাদের গ্রুপের সদস্য। তিনি সম্পর্কে সাংবাদিক আহমেদ শফিউদ্দিনের কন্যার পুত্র হন। সাংবাদিক আহমেদ শফিউদ্দিন এই ঘটনাটির গভীর তদন্ত না করলে হয়তো এমন একটা নৃশংস ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতো। সেই সূত্র থেকে আমরা ঘটনাটি আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত বোধ করছি।
মাশফিকুর রহমান হিমেল 
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়