বিশ্বের দেশে দেশে অপরাধীদের সংঘবদ্ধচক্র আছে। হলিউডের আশীর্বাদে গড ফাদার, মাফিয়া, গ্যাংস্টারদের কথা জানলেও, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী এবং সংঘবদ্ধচক্র ইয়াকুজাদের ব্যাপারে পৃথিবীর ধারণা কম। আজকের এই আর্টিকেলে, ইয়াকুজাদের ব্যাপারে এমন দশটি বিষয় আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হবে, যা হয়তো অপরাধচক্র সম্পর্কে আপনার ধারণা বদলে দিতে পারে।  



১. সামাজিক বৈষম্য যেভাবে জন্ম দিয়েছিলো ইয়াকুজা মাফিয়াদের  



ইয়াকুজাদের জন্মের ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরোনো। এখনো তাদের অনেক নীতি তাদের পূর্বপুরুষদের নীতির আদলে গড়া। সামন্তবাদী জাপানের সমাজে প্রচলিত গোত্র প্রথা অনুযায়ী, উঁচু নিচু শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ছিলো। সমাজের নিচু শ্রেনীর মানুষদের বলা হতো বুরাকুমিন। যারা কসাই, জল্লাদ, সুইপার এবং চামড়া শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সমাজ তাদের কার্যত একঘরে করে রাখত।  বুরাকুমিনরা কখনও, বুরাকুমিন ব্যতীত অন্য মানুষকে স্পর্শ করার অধিকার রাখতো না।

এই নিপীড়িত মানুষরাই নিজেদের সম্মান এবং সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সৃষ্টি করেছিল বর্তমানে, ২৮ হাজারের বেশি সদস্য বিশিষ্ট ইয়াকুজা অপরাধীচক্রের। ধারণা করা হয়, ইয়াকুজাদের ৭০ শতাংশ সদস্য বুরাকুমিন সমাজ থেকে এসেছে।    



২. ইয়াকুজা পশ্চিমে কতৃক প্রচলিত একটি শব্দ  



ইয়াকুজা সদস্য বা সাধারণ জাপানিরা সাধারণত ইয়াকুজা শব্দটি ব্যবহার করেনা। ইয়াকুজারা নিজেদের "নিনকো দানতাই" বলে, যার অর্থ- "সাহসী সংঘ"। তবে, জাপানিজ পুলিশ এবং মিডিয়া তাদের বরিওকুদান বলে সম্মোধন করে যার অর্থ, "হিংস্র দল"।

মজার ব্যাপার হলো, ইয়াকুজা শব্দটি এসেছে এক ধরনের তাস খেলা থেকে, যা মূলত ৮-৯-৩ সংখ্যাগুলোর জাপানিজ উচ্চারণ।  





৩. গা ভর্তি ট্যাটুর রহস্য  



ইয়াকুজাদের চেনার সহজ উপায় হল ধোপদুরস্ত কোর্ট প্যান্টের নিচে লুকায়িত গা ভর্তি ট্যাটুর বাহার। ইয়াকুজা সদস্যরা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া জনসম্মুখে তাদের ট্যাটু দেখায় না। মূলত সমাজের ছিন্নমূল মানুষেরা, ইয়াকুজাদের খাতায় নাম লেখায়। ইয়াকুজাদের বিশ্বাসভাজন হলে, একজন মানুষকে তার আসল পরিবার এবং সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন মানুষ ইয়াকুজা হিসেবে যোগদান করার পর চাইলে তার পুরো শরীরে এমন ট্যাটু করাতে পারে, যা অনেক যন্ত্রণাদায়ক এবং সদস্যের জন্য সম্মানজনক।  





৪.ইয়াকুজারা যেভাবে উপার্জন করে  



ইয়াকুজাদের আদিপুরুষেরা মূলত চোরাই মাল বিক্রি হয়, এমন দোকানে নিরাপত্তার বিনিময় অর্থ নিতেন।  পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ, গুপ্তহত্যা, মাদক চোরাকারবারি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, পর্নোগ্রাফি, নিরাপত্তা প্রদানের নিশ্চয়তা, ব্ল্যাকমেইল ইত্যাদি দ্বারা তারা উপার্জন শুরু করে।

কিছু ডকুমেন্টস বলে, বর্তমানে ইয়াকুজারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির মালিক।  




৫.আধুনিক জাপান বিনির্মাণে ইয়াকুজাদের ভূমিকা



জাপানের সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, একসময় ইয়াকুজাদের ব্যবহার করেছে বছরের পর বছর। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য কোন এলাকা খালি করার জন্য, ইয়াকুজাদের পরোক্ষভাবে ব্যবহার করতো জাপানের সরকার ও  বৃহৎ করপোরেশনগুলো। তবে ইয়াকুজারাই প্রাথমিকভাবে অনুন্নয়নশীল এলাকায় নিজেরাই রিয়েল এস্টেটের কাজ শুরু করতো। এজন্য স্থানীয় মানুষদের নানাপ্রকারে উত্ত্যক্ত করে বসতভিটা থেকে কৌশলে তাড়িয়ে দিতো ইয়াকুজারা। যদিও বিষয়টি জঘন্য, তবে জাপানের সামষ্টিক উন্নয়নের জন্য বিশ্লেষকেরা এটিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন।  



৬. সামাজিক আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ইয়াকুজা



ইয়াকুজা কোন একক চক্র নয়। এটি অনেকটা গণতন্ত্রের মতো, যেখানে বিভিন্ন আদর্শের দল একই ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়।

জাপান ব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইয়াকুজারা কিন্তু, চুরি ডাকাতির মতো ছোট এবং হীন অপকর্ম করে না। তারা অনেকটা "হোয়াইট কলার ক্রিমিনালস"।

বরংচ ইয়াকুজা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এসব ছোটখাটো অপকর্ম কম হয়। তবে এই চিত্র আগে এমন ছিলোনা। চাঞ্চল্যকর একটি হত্যাকাণ্ড এবং সরকারের ক্রাকডাউন নীতির কারণে ইয়াকুজাদের অপরাধ প্রবণতা কমে গেছে বলে দাবি করা হয়। বর্তমানে জাপানের ইয়াকুজারা

অনেক জনগণের কাছে হিরো হিসেবে আখ্যায়িত হয়।    



৭. ২০১১ সালের সুনামি সহায়তা  



ইয়াকুজারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্গানাইজেশন। অপরাধ জগতেই তাদের বিচরণ।

কিন্তু ২০১১ সালে যখন জাপানে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস এবং ভূমিকম্প হয়, তখন বিশ্ববাসী টনক নাড়ায় এই ইয়াকুজা বাহিনী। বিধ্বস্ত টহুকো শহরের লোকেরা সরকারি সহায়তার আগে ইয়াকুজাদের ট্রাকভর্তি ত্রাণ সহায়তা পায়। প্রায় ৭০টি ট্রাক ভর্তি ত্রান সহায়তা এবং সুপ্রশিক্ষিত ইয়াকুজা গ্যাং মেম্বাররা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। যা পুরো বিশ্বকে অবাক করে দেয়।


ইয়াকুজাদের "নিনকো কোড" নামক একটি নীতি আছে। যেটি অনুযায়ী তারা কখনোই জনসাধারণের ক্ষতি হয় এমন কিছু করতে পারে না। বরং তারা বিভিন্ন সময় মানুষের কাছ থেকে যে অর্থ উৎকোচ নেয় তাকে "কর" হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনকি, জাপানের নিউক্লিয়ার বর্জ্য সমস্যা সমাধানের জন্য ইয়াকুজারা নিজেদের লোকবল দিয়ে সাহায্য করে। তবে মূল ঘটনা আরেকটু জটিল।    



৮. আন্তর্জাতিক বিশ্বে ইয়াকুজাদের প্রভাব



জাপানের বাইরে পৃথিবীর বহু দেশের জেলখানায় ইয়াকুজা সদস্যরা বন্দী আছে। তাদের অধিকাংশই জেলে আছেন মাদক চোরাচালানের জন্য। তবে, বিশ্বের সকল বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের ইয়াকুজাদের সমঝে চলে, তাদের কৌশলী ব্যবসায়িক নীতির জন্য। ইয়াকুজারা, যেকোনো একটি কোম্পানির ন্যূনতম শেয়ার ক্রয় করে যাতে করে তারা বোর্ড মিটিংয়ে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। তারপর বোর্ড মিটিং এই প্রকাশিত হয় তাদের আসল পরিচয়! আর এভাবেই ভয় ভীতি দেখিয়ে তারা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক দুনিয়ার  গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ। তবে অনেক কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণে ঋণ সহায়তা দিয়ে ইয়াকুজারা সাহায্য করেছে একথাও সত্যি।    



৯. ইয়ামাগুচি গুমি এবং কেনেচি শিনোডা  



জাপানের সর্ববৃহৎ ইয়াকুজা গ্রুপের নাম হল "ইয়ামাগুচি গুমি"। যাদের ৮৯০০ এর উপর সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

ইয়ামাগুচি গুমির বর্তমান প্রধান কেনিচি শিনোডার বর্তমান বয়স ৭৮ বছর বয়স। তিনি ১৯৭০ সালে একজন প্রতিপক্ষ ইয়াকুজা নেতাকে কাটানা দিয়ে হত্যা করার দায়ে ১৩ বছর জেল খাটেন। তিনি ইয়ামাগুচি গুমির প্রধান হিসেবে ঘোষণা পাওয়ার চার মাসের মাথায় তাকে আবার অবৈধ অস্ত্রের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। শিনোডা ২০০৫ থেকে ২০১১ পর্যন্ত কারাভোগের পর মুক্তি পেলেও, ওবামা প্রশাসন ২০১২ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

শিনোডাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। ক্ষমতায় আরোহনের সময় তাকে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে মূল অনুষ্ঠান কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব আসলে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং সাধারন ট্রেনে চড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছান। এছাড়া তাকে অনেকবার ফুটপাতের একটি ভাসমান দোকানে রামেন খেতে দেখা গেছে।  




১০. ইয়াকুজাদের মানবতাবাদী কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য  



বহু বছর জাপানের সামন্তবাদী সামাজিক কাঠামোতে নিপীড়নের শিকার হওয়ার ফলে ইয়াকুজারা সামাজিক বৈষম্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। বিগত দিনগুলোতে তাদের অনেক জনসেবামূলক কাজ করতে দেখা গেছে।

তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের ইয়াকুজাদের একটি বড় অংশ এই নতুন পলিসি গ্রহণ করেছে। এতে করে অনেক জাপানি ব্যক্তি ইয়াকুজাদের জাপানের জন্য উপকারী মনে করেন। তবে ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা এবং সরকারের কিছু বিরূপ নীতির কারণে ইয়াকুজাদের এই পলিসি অনেক মানুষের আইওয়াসে সক্ষম হয়েছে। অনেকেই জানেন না যে, জাপানের নিউক্লিয়ার বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য ইয়াকুজারা তাদের দলের দুর্বল এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাধ্য করে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলো বলে শোনা যায়।   




আহসানুল অহিন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ছেন।