ভাইকিংসঃ সেই জলদস্যুর দল - লিখেছেন - জুনায়েদ ইসলাম
টিভি সিরিজের পাগল আর হিস্টোরি চ্যানেলের ভাইকিংস টিভি শো’র নাম শোনেননি এমন দর্শক পাওয়া মুশকিল।মাস্ট ওয়াচ এই সিরিজটির সৃষ্টির পেছনের কারিগর মূলত ছিলেন মাইকেল হার্স্ট। শুটিং হয়েছে আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায়। দুনিয়া জুড়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সিরিজটির এই মুহূর্তে ষষ্ঠ সিজন চলছে আর ১০টি এপিসোড বাকি রয়েছে যার মাধ্যমে ইতি টানবে সিরিজটি। ইতিহাসখ্যাত র্যাগনার লথব্রকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ট্র্যাভিস ফিম্মেল ও সবচেয়ে বেশি আলোচ্য চরিত্র লাগার্থার ভূমিকায় রয়েছেন ক্যাথেরিন উইনিক। উইনিকের অভিনয়ের কল্যাণেই মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে বহুদিন আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাগার্থা চরিত্রটি। সোনালি চুলের যোদ্ধা লাগার্থা কিংবা ঘরকন্নায় ব্যস্ত সাধারণ ভাইকিং নারী- দুই ভূমিকাতেই চমৎকার তিনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৩ সালে শো-টি শুরু হবার আগে নারীদেরও ভাইকিং যোদ্ধা রূপে দেখানোয় বেশ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল পরিচালককে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘাটলে এমনটিই দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি ভাইকিং যুগে শুধু অভিবাসন নয়, রণাঙ্গনেও সমান পারদর্শী ছিল নারীরা।সিরিজটি দেখে শেষ করার পর এদের ইতিহাসটা জানতে অনেক কৌতূহলী হয়ে যাই ।তারপর বিভিন্ন অনলাইন রিসোর্স ঘেটে এ ব্যাপারে যা যা জানতে পারি তাই মূলত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একটা সত্যি এই যে সিরিজটি ইতিহাসকে অনুসরণ করেনি পুরোপুরি। পর্দায় এনেছে মনগড়া কিছু চরিত্র ও অদলবদল করেছে অনেক সময়ের ব্যাপ্তি। যেমন সিরিজের মতো বাস্তবে র্যাগনারের 'রোলো' নামের কোনো ভাই ছিল না। রোলো নামের একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল কিন্তু সে র্যাগনারের ভাই ছিল না তবে এসব কারণে জনপ্রিয়তার স্রোতে ভাটা পড়তে কিন্তু দেখা যায় নি।তাহলে চলুন ইতিহাসের দিকে একটু ঘুরে আসি।
'ভাইকিংস'সম্পর্কে জানার আগে জানা প্রয়োজন এই শব্দটি কিভাবে এলো । এটা নিয়েও দুটি মতভেদ আছে ।প্রথমত বলা হয় ভাইকিং নামটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান থেকে এসেছে, পুরনো নরওয়েজিয়ান শব্দ "বিকা" (উপসাগর বা খাদ) থেকে। আবার এটাও জানা যায় যে শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন নর্স টার্ম ‘ভিকিঙ্গর’ থেকে। 'ভিকিঙ্গর' শব্দটির অর্থ জলদস্যু। ভাইকিং বলতে বোঝায় স্ক্যানডিনেভিয়ান পুরুষদের ও নারীদের, যারা ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, রাশিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতো। স্ক্যানডিনেভিয়া অঞ্চলগত প্রধান তিনটি দেশ হচ্ছে সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়ে। তবে অনেকেই ওলান্ড দ্বীপপুঞ্জ, ফারো দ্বীপপুঞ্জ, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডকেও স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশের কাতারে ফেলেন। ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত টানা ৩’শ বছর ইউরোপের এক বিরাট এলাকা জুড়ে লুটতরাজ চালায় ও বসতি স্থাপন করে এরা। এদেরকে নর্সম্যান বা নর্থম্যানও বলা হয়। এরা পূর্ব দিকে রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন্যদিকে পশ্চিমদিকে গ্রিনল্যান্ডে এরা ৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে এবং সম্ভবত প্রথম ইউরোপীয় জাতি হিসেবে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকা মহাদেশ আবিস্কার করে এমনটিই পাওয়া যায় ইতিহাসে। আইসল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনেক গাথায় ভাইকিংদের শৌর্য-বীর্যের কথা বলা হয়েছে। টেকনিক্যালি নারীদের ‘ভাইকিং’ হবার অধিকার ছিল না।এ ব্যাপারে বহুত মতভেদ আছে।কারণ ইতিহাসখ্যাত শিল্ডমেইডেন দের কথা কিন্তু আমরা সবাই জানি যারা পুরো ছিলই নারীদের গ্যাং। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত 'ওম্যান ইন দ্য ভাইকিং এজ' বইয়ের লেখিকা জুডিথ জেশ্চের মতে, ভিকিঙ্গর বলতে বোঝানো হতো স্রেফ পুরুষদের। লম্বা নৌকায় পাল তুলে স্ক্যানডিনেভিয়ান পুরুষরা ছুটে বেড়াতো ব্রিটেন, ইউরোপ, রাশিয়া, উত্তর আমেরিকা আর উত্তর আটলান্টিকের দ্বীপগুলোতে। সময়টা তখন ৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ। তারা সফল ব্যবসায়ীও ছিল তবে তারা কুখ্যাত হয়েছে তাদের বিদ্ধংসী সব যুদ্ধের জন্য। এটা মানতেই হবে যে পৃথিবীব্যাপী ভাইকিংরা আবিষ্কার করেছে বাণিজ্যিক চলাচলের পথ, স্থাপন করেছে বসতি, প্রতিষ্ঠা করেছে বিভিন্ন শহর (উদাহরণ হিসেবে ডাবলিনের কথাই বলা যায়)। শুধু তা-ই না, যেখানেই তাদের জাহাজ পৌঁছাতে পেরেছে, সেখানকার ভাষা আর সংস্কৃতিতেও তাদের প্রবল প্রভাব পড়েছে।
ভাইকিংসদেরকে ইউরোপীয়রা নিজেদের স্বজাতি হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। কারন তারা একটি বিদেশী জাতি হিসাবে এসেছিল এবং তাদের কর্মকাণ্ড ছিলো বর্বরোচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তারা খৃস্টান ছিলো না। ভাইকিংদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল এখনকার সময়ের নরওয়ে সুইডেন এবং ডেনর্মাক হিসাবে পরিচিত এলাকাগুলিতে, এই দেশগুলো একত্রে স্ক্যান্ডিনেভিয়া হিসেবে পরিচিত। তারা যে দেশে বাস করত সেখানকার মাটি ছিলো ভয়াবহ রুক্ষ আর অনুর্বর। সেই সঙ্গে ছিল তীব্র শীতের প্রকোপ। অনেকটা বাঁচার তাগিদেই প্রতি বছর জাহাজে চেপে বিভিন্ন দেশে অভিযানে বের হতো তারা। লুটের মাল যত বেশী হবে, তত আরামে কাটবে শীতের মৌসুম। তাই লুটপাট চালানোর ব্যাপারে তারা ছিলো অসম্ভব নির্মম আর অসভ্য।সেই সময় ভাইকিংদের জাহাজ দেখা আর আজরাইলকে দেখা–এই দুটোই ইউরোপের মানুষের কাছে ছিলো সমান বিষয়। আজকে মার্ভেলের সুবাদে আমরা যে থর, ওডিন আর লোকিদের নিয়ে তৈরী মুভি দেখি, এরাই ছিলো এসব নর্থমেনদের উপাস্য দেবতা এমনটিই শোনা যায়। ইতিহাসের ব্যাপারে খুব প্রচলিত একটি কথা হলো, 'বিজয়ী'দের হাতেই এটি সবসময় তৈরি হয়ে থাকে। তবে ভাইকিংদের বেলায় এখানে প্রভাব রেখেছে ধর্ম, আরো ভালো করে বললে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইতিহাসবিদগণ। তারাই ভাইকিংদেরকে মূর্তিপূজক এবং নাস্তিক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দলিলপত্র বলছে ভিন্ন কথা। ভাইকিংদের ধর্ম ছিলো বেশ সাজানোগোছানো। এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য কতগুলো নিয়মকানুন উল্লেখ করে দেয়া ছিলো, যাতে করে তারা সুন্দর একটি জীবনপথের সন্ধান পায়। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থ অবশ্য তাদের ছিলো না। তবে ধর্মীয় নানা উপকথা প্রজন্মান্তরে লোকমুখে চলে এসেছিলো।আজকের দিনের প্রধান ধর্মগুলোতে যেমন বিভিন্ন উপাসনালয়ে গিয়ে ধর্মচর্চা করতে দেখা যায়, ভাইকিংদের বেলায় এমনটা ছিলো না। বরং প্রাচীন সেল্টদের মতো তারা বাস্তব জগতের বিভিন্ন জিনিসকে পবিত্রজ্ঞান করতো, যেমন- গাছপালা ও নদী। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালনের কাজটি দেখভাল করতেন যাজকগণ। সাধারণত পরিবারের কর্তাব্যক্তিরাই এই পদটি পেতেন।
সভ্যতার মানদন্ডে রীতিমতো অসভ্য আর বর্বর এই জাতি সাগরে অসম্ভব সব দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে, নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করেছে। আর এ সমস্ত কিছুই তারা করেছে একদম নিজেদের প্রচেষ্টায়। ভাইকিংরা জাহাজ বানানোতে ছিলো অসম্ভব রকমের পটু। একটা জাহাজ কোন পথে যাবে বা কি পরিমাণ ভার বহন করতে হবে এসব বিবেচনা করে তারা জাহাজ নির্মাণ করতে পারতো। প্রতিটি অভিযান শেষে নিরাপদে ফেরত আসা নাবিকদের মুখে সমুদ্রযাত্রার বিবরণ শুনে সেই রুটের জাহাজের নকশা তৈরী করতো নির্মাতারা। সাধারনত দুই ধরনের জাহাজ বানাতো, তার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলো ‘ল্যাংস্কিপ’ যেটা ছিলো আদতে যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজগুলোতে চেপে তারা হামলা করতো বিভিন্ন দেশে। ৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে, উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় ইংল্যান্ডের নর্থমার ল্যান্ডের উপকূলে লিন্ডসফার্নে এক সন্ন্যাসীদের আশ্রমে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ভাইকিং যুগের সূচনা হয়েছিল। এ কথা ঠিক যে, ভাইকিংসরা অতীতে বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ ভালোই ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। খ্রিস্টান অধ্যুষিত সেসব এলাকার জনগণ লেখাপড়া জানার কারণে সেসব ঘটনা লিপিবদ্ধ করা ছিল, কখনো কখনো যা আবার ছিল অতিরঞ্জিত। আলকুইন অফ ইয়র্ক বিশপ হিগবাল্ডের কাছে এই ভাইকিংদের নৃশংসতা বর্ণনা করেই লিখেছিলেন,
“এই মূর্তিপূজক জাতি পুরো ব্রিটেন জুড়ে যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে, এমনটা আগে কখনো হয়নি... এই বর্বরগুলো বেদীর চারপাশ যাজকদের রক্তে রঞ্জিত করেছে। শুধু তা-ই না, ওরা গির্জায় যাজকদের মৃতদেহগুলো এমনভাবে পদদলিত করেছে, যেমনটা আমরা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বিষ্ঠার বেলায় করে থাকি।“
ব্রিটেনে ভাইকিংরা আসলেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। এমনকি তাদের হাতে নিহত এমন অনেকের কঙ্কালও পাওয়া গিয়েছে যাদের হাড়ে তখনও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি আটকে ছিল। নর্থ হার্টফোর্ডশায়ার মিউজিয়ামে একটি কঙ্কাল আছে, যার গলা এফোঁড়-ওফোঁড় করে গিয়েছে ভাইকিংদেরই একটি বর্শা। বেশ কিছু ভাইকিং সদস্য ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও তাদের অধিকাংশই কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতো।তবে, এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তখনকার সময়টাই আসলে এমন ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকেই ক্ষমতা ও নৃশংসতার দিক দিয়ে ভাইকিংদের সমকক্ষ ছিলো কিংবা তাদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগের শুরুর দিককার জনপ্রিয় এক নাম ছিলো সম্রাট শার্লেম্যাগনে। ৭৮২ সালে তার বাহিনী স্যাক্সনিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোককে হত্যা করেছিল, ইতিহাসে যা 'ম্যাসাকার অফ ভার্ডেন' নামে পরিচিত। কিন্তু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী শার্লেম্যাগনের একজন খ্রিস্টান জীবনীকার ছিলেন, যিনি তার অন্নদাতার ভালো কথাগুলোই কেবল লিখে গিয়েছেন, তাকে উল্লেখ করেছেন বিধর্মীদের (মূর্তিপূজকদের) হন্তারক হিসেবে, ফুটিয়ে তুলেছেন 'ফাদার অফ দ্য চার্চ' হিসেবে। এর ফলশ্রুতিতে তার নিষ্ঠুরতা অতটা প্রচার পায়নি, যতটা পেয়েছিল ভাইকিংদের বেলায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সাক্ষ্য দেয় যে, তৎকালে ভাইকিংরা বিভিন্ন অঞ্চলে লুটপাট চালাতো, জ্ঞাত পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে ধনরত্ন এনে ভরিয়ে তুলতো তাদের অর্থভাণ্ডার। কিন্তু তাই বলে তাদের সবাই কিন্তু এমন ছিলো না। অনেকেই নতুন পা রাখা/বিজিত অঞ্চলসমূহে থেকে গিয়ে সেখানের প্রভূত উন্নতিতে দীর্ঘস্থায়ী অবদান রেখেছে। ৮৪১ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা ডাবলিন হলো ভাইকিংদের হাতে তৈরি একেবারে প্রথম দিককার একটি স্থাপনা। ধীরে ধীরে পণ্য উৎপাদনের দিক দিয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে এটি। এখানে গড়ে ওঠে একটি বন্দর, এমনকি টাকশালও। ডাবলিনের পাশাপাশি ইয়র্কের জরভিক শহরের উত্থানের পেছনেও আছে এই ভাইকিংদের অবদান।আইসল্যান্ডকে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতে হবে ইনগল্ফ্র আর্নান্সনের প্রতি, যার তত্ত্বাবধানে একে একে সেখানকার স্থাপনাগুলো দেখছিলো আলোর মুখনরম্যান্ডিও ভাইকিংদের গঠনমূলক মনোভাবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ভবিষ্যতে ভাইকিং আক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য রাজা তৃতীয় চার্লস ফ্রান্সের উত্তরে তাদের থাকার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দেন। এমনকি নিজের মেয়েকে তিনি বিয়ে দেন নরওয়েজীয় নেতা রলোর সাথে। এর মধ্য দিয়েই ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে আপন করে নিতে শুরু করে ভাইকিংরা।
ভাইকিংসদের অস্ত্রের দিকে আসা যাক এবার ।এদের কথা ভাবতে গেলেই প্রথমে তাদের যে প্রতিকৃতি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সেখানে তাদের মাথায় থাকে একটি হেলমেট, যাতে আবার দু'পাশে থাকে দুটি শিংয়ের মতো অংশ। তবে বাস্তবতা হলো, ভাইকিংরা আসলে কোনোদিনই এমন শিংযুক্ত হেলমেট ব্যবহার করেনি। তাদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও জনপ্রিয় এই ধারণার বিপক্ষেই কথা বলে। তারা হেলমেট ব্যবহার করতো ঠিকই, তবে সেগুলো ছিল আর আট-দশটা হেলমেটের মতোই সাধারণ, যার উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র পরিধানকারীর মাথার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রতিপক্ষ যদি মুগুর, কুঠার কিংবা ধারালো তলোয়ার নিয়ে আঘাত হানতে আসতো, তাহলে দক্ষতা ছাড়া শুধুমাত্র হেলমেটের উপরের শিং দিয়ে কী এমনই বা করা সম্ভব! আসলে, বিচিত্র ডিজাইনের এই হেলমেটের ধারণা মানুষের মনে ঠাই পেয়েছে উনিশ শতকে এসে, রিচার্ড ওয়াগনারের 'দ্য রিং সাইকেল' (জার্মান কম্পোজারের চারটি অপেরার এ সম্মিলনটি নর্স বীরকাহিনীর বিভিন্ন চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল) এর মাধ্যমে। কস্টিউম ডিজাইনার কার্ল এমিল ডোপলার ১৮৭০ এর দশকে ভাইকিং চরিত্রগুলোর জন্য যেসব হেলমেট ডিজাইন করতেন, সেখানেও দর্শকদের মনে ভীতিজাগানিয়া আবহ সৃষ্টি করতে তিনি শিং জুড়ে দিতেন। এভাবেই বাস্তবে না থাকলেও শিল্পের কল্যাণে হেলমেটে শিং পেয়ে যায় ভাইকিংরা। পরবর্তীতে কার্টুনিস্ট, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রশিল্পীদের হাত ধরে এই শিংগুলো আজও তাদের জায়গা ধরে রেখেছে।
তৎকালীন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী লেখকেরা ভাইকিংদের মূর্খ ও বর্বর বলেই মনে করতেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো এ কথাটিও সত্য না। বেশ জটিল এক হস্তলিপির বিকাশ ঘটেছিল এই ভাইকিংদের হাত ধরে, যা ‘রুন’ নামে পরিচিত। প্রতীকে ভরপুর এই রুনিক বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণই আবার আলাদা আলাদা শব্দের সাথেও সম্পর্কিত ছিলো। যেমন- রুন ‘এফ’কে তারা বলতো ‘ফেওহ্’, যার অর্থ ধনসম্পদ বা গবাদিপশু। আধ্যাত্মিক বিভিন্ন অর্থও বহন করতে পারতো রুনিক বর্ণগুলো। শুরুর দিকে পাথরে খোঁদাই করা হলেও কালক্রমে চিরুনি ও অস্ত্রের মতো ব্যক্তিগত নানা জিনিসেও এই রুন খোঁদাই করা হতো। বিভিন্ন সময়ই ভাইকিংদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন তারা বেশ বড় বড় চুল-দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবার তাদের জীবনটাও বেশ অগোছালো। তবে প্রকৃত সত্যের সাথে এরও রয়েছে বিস্তর ফারাক।ভাইকিংদের ব্যবহার্য অসংখ্য চিরুনি ও রেজরের সন্ধান আমাদের এটাই জানান দেয় যে, নিজেদের সাজসজ্জার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তারা মোটেও বেখেয়ালী ছিলো না। তাদের বাসস্থানগুলো মোটেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, অপরিষ্কার কুঁড়েঘরের মতো ছিলো না। বরং সেগুলো হতো বেশ বড়সড়, আকর্ষণীয় হলের মতোই।
খাবারদাবারের বেলায় বেশ সচেতন ছিলো তারা, বিশেষ করে প্রচুর পরিমাণে মাছ থাকতো তাদের খাদ্যতালিকায়। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বাসস্থানগুলো সমুদ্রের তীরে হওয়ায় এতে আসলে অবাক হবার মতো কিছু নেই। তাদের মলমূত্র ত্যাগের স্থানগুলো পরীক্ষা করে জানা গেছে- এল্ক (বৃহদাকৃতির হরিণ), ভালুক, পাফিন (দীর্ঘ ঠোঁটের সামুদ্রিক পাখিবিশেষ), স্যামন ও ট্রাউট মাছ নিয়মিত থাকতো তাদের খাদ্যতালিকায়।
অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় তারা ছিল অদ্ভুত রকমের আগ্রাসি। আশ্রমের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি তারা কোন শ্রদ্ধা দেখায়নি। এর দুই বছর পরে, তারা স্কি ও আইওনা এবং রাথলিন (আয়ারল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব উপকূলে বন্ধ) এর অনির্ধারিত দ্বীপ, আশ্রম ও মঠ গুলিতে আঘাত হানে ।৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ফ্রাইকা (আধুনিক দিনের ফ্রান্স ও জার্মান) -এর রাজা লুইসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র লোথর তার ভাইদের যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য ভাইকিংদের কাছে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য । সংগ্রামের অনেক আগেই ভাইকিংরা বুঝতে পেরেছিল যে ফ্র্যাঙ্কিশ শাসকরা তাদের অর্থ প্রদান করতে ইচ্ছুক । তাই তারা এ সুযোগর সৎব্যাবহার করেন। এর ফলে তাদের প্রভাব ইউরোপে আরও বিস্তৃত হয়।ভাইকিংরা নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড অভিযান পরিচালনা করে। নতুন কোনো জনপদ থেকে তাদের একজন অভিযাত্রী বেঁচে ফিরে আসতে পারলেই পরের মৌসুমে তারা সেই রুটে রওনা হয়ে যেতো ড্রাগন জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে। আর আক্রান্ত দেশটি নিমেষে পরিনত হতো হাবিয়া দোজখে। ইংল্যান্ড নামের দেশ নিয়ে ভাইকিংদের ভেতর অনেক কথা প্রচলিত ছিলো । তারা জানতো সূর্যাস্তের দিকে সাতদিন একটানা জাহাজ চালালে একটা সবুজ দেশ দেখা যায়। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজেদের জন্য স্থায়ি বসবাস তৈরি করা । তারা "ওয়াইল্ডস স্কটল্যান্ডের" উত্তরাঞ্চল, হিব্রাইডস্ এবং স্কটল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। তারাই আয়ারল্যান্ডের প্রথম বাণিজ্যিক শহরগুলির প্রতিষ্ঠা করেছিল। ডাবলিন, ওয়াটারফোর্ড, ওয়েক্সফোর্ড, উইকলো এবং লিমেরিক ইত্যাদি স্থানগুলো ব্যবহার করে আয়ারল্যান্ড এবং আইরিশ সাগরে সারা ইংল্যান্ডের উপর হামলা চালান হত। আইরিশ উপকূলের উপর তাদের বেস ব্যবহার করে। ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমনের সূচনা ঘটে। রাজ্য-ওয়েসয়েক্স সফলভাবে প্রথম বারের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। ভাইকিং বাহিনী পূর্ব এঙ্গেলিয়া ও নর্থবারল্যান্ডের জয়লাভ করে। ৮৯৩ সালের কথা, সেবছরেই প্রথমবার সফলভাবে ইংল্যান্ডে পৌছে লুটপাট চালিয়েফেরত আসতে সক্ষম হয় তারা।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর এক তথ্য অনুযায়ী, ভাইকিং দের সমগ্র অর্থনীতি গড়ে ওঠেছিলো কৃতদাস বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ।এমনকি তারা তাদের মনিবদের মৃত্যুতে ক্রীতদাসদের উৎসর্গ করতো। ২০১৪ সালের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অভ্ আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স’ অনুসারে লৌহযুগের অর্থাৎ ৫৫০ থেকে ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দের একটি সমাধিস্থল পাওয়া গেছে যেখানে তিনটি একক, দুটি যৌথ ও একটি ত্রৈধ সমাধিসহ মোট ১০ জনের সমাধি পাওয়া গেছে। এছাড়াও চারটি মস্তকহীন কঙ্কাল পাওয়া যায়। ভাইকিংদের শবের সাথে মস্তকবিহীন দাসদের লাশ পাওয়া মৃত মনিবদের উপহার কিংবা মৃত আত্মার ভোজন হিসেবে ক্রীতদাসদের শিরশ্ছেদের ঘটনাটিরই নিশ্চয়তা দেয়।২০১৫ সালে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী এক টন জীবাণুর ডিম পায় যা থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসে যে ভাইকিং দের মধ্যে ক্রিমির সংক্রমণ হয়েছিলো যার প্রভাব এতোই গুরুতর ছিলো যে ভাইকিংদের জেনেটিক্সে পরিবর্তন চলে এসেছিলো যেনো এসব সংক্রমণের প্রভাবের সাথে তারা যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারে। প্রত্নতত্ত্বের মতে,ভাইকিংদের মধ্যে অণুর অস্বাভাবিক একটি সংস্করণ পাওয়া যায় যার নাম আলফা-১-এনটিট্রিপসিন বা A1AT।শতবছর আগে এ অণুটিই তাদের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলো। এ অণুটির জেনেটিক ফ্যাক্টর এখনের একমাত্র শ্বাসকষ্টজনিত রোগ এমফি’সীম এবং COPD এর সাথে মিলে। এ অস্বাভাবিক জীনগুলো এখন পরিবাহী জীবাণু না পেতে পেতে শরীরের অন্যান্য অংশে ক্ষতি করা শুরু করেছে।
ভাইকিং সমাজে নারীদের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নানাবিধ কাজে দিনের পর দিন ঘরের বাইরে কাটাতো, তখন পরিবার সামলানো, ঘরবাড়ি ও সম্পত্তির দেখাশোনার যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়তো নারীদের কাঁধেই। বেশ কিছু নারীর সামরিক দক্ষতার দরুন তাদেরকে সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় পদ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।সমাজে নারীদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হতো। সমাজের প্রয়োজনে আধ্যাত্মিক নানা ভূমিকা পালনেও পিছপা হতেন না নারীরা। অনেক নারীর কবরে পাওয়া জাদুদণ্ড এ বিষয়েরই সাক্ষ্য দেয়। যদি স্বামী অসম্মানজনক আচরণ করতেন কিংবা গায়ে হাত তুলতেন, তবে তাকে তালাক দেয়ার অধিকারও ছিলো একজন ভাইকিং নারীর।
কিছুদিন আগেও ইতিহাসবিদরা মনে করতেন, দলবেধে জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিত কেবল নর্স পুরুষরাই। তবে সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৪ সালে গবেষকরা জানান, তারা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছেন, নর্স নারীরাও সমানতালে যোগ দিত সমুদ্রযাত্রায়। ভাইকিং যুগের প্রাক্কালে তারা ইংল্যান্ড, শেটল্যান্ড আর অর্কনি দ্বীপপুঞ্জ ও আইসল্যান্ডে অভিযান চালিয়েছে পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। শুধু তা-ই না, ভিনদেশে এসে বসতি গড়বার সময় মহিলারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আইসল্যান্ডের মতো জনমানবহীন জায়গায় নর্স রমণীরা অবদান রেখেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিকাশে।
অন্যান্য সভ্যতার মতো ভাইকিংদের সমাজও ছিল পুরুষ-প্রধান। শিকার, লড়াই, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ তারাই করতো, অন্যদিকে নারীরা রান্না-বান্না, ঘর সামলানো ও বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালনে ব্যস্ত থাকত। তবে ভাইকিং যুগের স্ক্যানডিনেভিয়ার মেয়েদের বেশ কিছু স্বাধীনতা বজায় ছিল। তারা বিষয়-সম্পত্তির মালিক হতে পারত, প্রয়োজনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারত, বকেয়া যৌতুক আদায়ও করতে পারত। সাধারণত মেয়েদের ১২-১৫ বছরের মধ্যে বিয়ে দেয়া হতো। বিয়ের সময় পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠানো হত, মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ জানাবারও সুযোগ ছিল।
বাইরে লঙ্কাকাণ্ড করে আসলেও গৃহকর্তার উপর খবরদারি ঠিকই ছিল স্ত্রীদের। শিকার বা রেইডের কাজে অনুপস্থিত থাকলে কিংবা অকালে স্বামীর মৃত্যু হলে ঘর চালাবার দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেরি করতো না নর্স রমণীরা। ফার্ম কিংবা ব্যবসা চালাতেও পটু ছিল তারা। ভাইকিং যুগে স্ক্যানডিনেভিয়ান অনেক মহিলাকেই চাবির গোছাসহ কবর দেয়া হতো। ঘরের কর্ত্রী হিসেবে তাদের মৃত্যুর পরেও সম্মান জানানো হত এভাবে।
কেউ কেউ অবশ্য গৃহকর্ত্রী থেকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন শাসকে। তবে সেটা হাতেগোণা দুয়েকজন। স্ক্যানডিনেভিয়ায় একবার এক বিশাল কবর খুঁজে পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। কবরটা ছিল ওসবার্গ রানীর। ওসবার্গ হচ্ছে একধরনের ভাইকিং জাহাজ। ৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পর তাকে মূল্যবান জিনিসপত্রসহ বিশাল এক ওসবার্গের ভেতর ঢুকিয়ে মাটিচাপা দেয়া হয়।
নবম শতাব্দীর শেষদিকে এক নরওয়েজিয়ান সর্দারের মেয়ে অউড দ্যা ডিপ মাইন্ডেড ডাবলিনে ওলাফ দ্য হোয়াইট-কে বিয়ে করে। স্বামী ওলাফ আর একমাত্র ছেলে থোরস্টেইনের মৃত্যুর পর অউড তার সংসারের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাতি-নাতনিসহ আইসল্যান্ডের উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে বসেন। পরবর্তীতে আইসল্যান্ডে উপনিবেশ পত্তনকালে তিনি খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
গুটিকয়েক ঐতিহাসিক দলিলপত্র সাক্ষ্য দেয় যুদ্ধে নারীদেরও ভূমিকা ছিল।
বাইজেন্টাইন যুগের ইতিহাসবিদ জোহানেস কাইলিটযসের লেখা থেকে জানা যায়, ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বুলগেরিয়ানদের বিরুদ্ধে ভারাঙ্গিয়ান ভাইকিংদের সাথে মিলে নারীরাও হাত রাঙাতে নেমেছিল। এছাড়াও দ্বাদশ শতাব্দীর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ড্যানিশ ইতিহাসবিদ স্যাক্সো গ্রামাটিকাস লিখে গিয়েছেন অস্ত্র চালনায় পারদর্শী একদল নারী যোদ্ধার কথা। তাদের ডাকা হতো শীল্ডমেইডেন নামে। পুরুষদের মতোই বর্ম পরিধান করত তারা, শিখত তলোয়ার চালনা ও অন্যান্য যুদ্ধকৌশল।
স্যাক্সো তার জেস্টা ড্যানোরাম নামের ইতিহাস কর্মের নবম বইয়ে লিখে গেছেন লাগার্থা নামের এক দুঃসাহসিক শীল্ডমেইডেনের কথা। এখানে উল্লেখ্য যে- স্যাক্সো লাগার্থা নয়, শীল্ডমেইডেনটির নাম লিখে গেছেন ‘লাথগার্থা’ (কোথাও কোথাও লাডগার্থা কিংবা লাজেরডা-ও বলা হয়) হিসেবে। কালের পরিক্রমায় ইংরেজি ভাষায় তা রূপ নেয় লাগার্থা-য়। যাই হোক, জেস্টার বক্তব্য অনুযায়ী লাগার্থার যোদ্ধা জীবনে প্রবেশের শুরুটা হয় সুইডেনের রাজা ফ্রো’র হাতে নরওয়েজিয়ান সম্রাট সিওয়ার্ডের হত্যার পর। ফ্রো মৃত রাজপরিবারের নারী সদস্যদের পতিতালয়ে ছুঁড়ে ফেলেন, তাদের মান-সম্মান ধূলিস্মাৎ হতে দেখে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন তিনি। এই নিষ্ঠুরতার কথা শুনে প্রতিশোধ নিতে ছুটে আসে তৎকালীন দুর্ধর্ষ ভাইকিং যোদ্ধা র্যাগনার লথব্রক। তার এভাবে হুংকার ছেড়ে আসাটা অযৌক্তিক ছিল না। কারণ নিহত সিওয়ার্ড সম্পর্কে ছিল তার দাদা। র্যাগনারের তাঁবুতে এসে সাথে দেখা করে অপমানিত-লাঞ্ছিত নারীদের একটা দল। তারা যোগ দেয় সুইডিশ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে। আর তাদের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লাগার্থা নামের এক অকুতোভয় নারী যোদ্ধা। স্যাক্সোর মুখ থেকেই শোনা যাক-
“লাডগার্থা, এক দক্ষ আমাজন। শীল্ডমেইডেন হওয়া সত্ত্বেও তার সাহস কোনো পুরুষের চাইতে কম ছিল না। সম্মুখ সমরে সে ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম, সবাই তার দক্ষতায় প্রবল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল। তবে তার পিঠে বাড়ি খেতে থাকা চুল বিশ্বাসঘাতকতা করতো- চটকা ভাঙিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল এই যোদ্ধা একজন মেয়ে।“
যুদ্ধে লাগার্থার পারদর্শীতা দেখে র্যাগনার মুগ্ধ হয়ে যায়, শুধু তাই না- মেয়েটি সম্ভ্রান্ত বংশের জানার পর তাকে একান্ত করে পাবার বাসনা জেগে উঠে তার মাঝে। র্যাগনার লাগার্থার বাসায় একের পর এক বার্তা পাঠাতে থাকে। স্যাক্সো বলেন- লাগার্থা তখন স্রেফ প্রেমে পড়ার ভান করছিল, র্যাগনারকে কামনার ফাঁদে ফেলে ডেকে আনছিল নিজের কাছে। লাগার্থা এসময় একটা উদ্ভট কাজ করে বসে, গলারডাল উপত্যকার (বর্তমানে নরওয়ে) অবস্থিত নিজের বাসায় একটা ভালুক আর কুকুরকে পাহারা বসায়। প্রেমিক-প্রবর আসা মাত্রই ভয়ঙ্কর জন্তু দুটো তাকে ছিঁড়ে ফেলবে। ওদিকে প্রেমে অন্ধ র্যাগনার নিশ্চিন্ত মনে পাড়ি জমায় ভালোবাসার মানুষটির উদ্দেশ্যে, জানে কোনো বাধা নেই তাদের দু’জনের মাঝে। তার তখনই বোকা বনে যায় দুই পাহারাদারকে দেখে। তবে র্যাগনারের মতো প্রতাপশালী যোদ্ধার সামনে টিকতে পারেনি প্রাণী দুটো। ভালুকটিকে বর্শা ছুঁড়ে ও কুকুরটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সে। আর এভাবেই রক্ত ঝরিয়ে জিতে নেয় প্রিয়তমার মন।
তাদের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র পুত্র ফ্রিডলেইফ ও দুই মেয়ে। তবে মেয়েদের নাম সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা অবগত নন। লাগার্থার সাথে নরওয়েতে তিনটি বছর কেটে যায়। এরপর গৃহযুদ্ধ সামাল দেবার জন্য র্যাগনার ডেনমার্কে ফিরে আসে। তবে সে মনে মনে ক্ষুণ্ন হয়েছিল তখনও, লাগার্থা এভাবে ভালুক-কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল- এটা সে হজম করতে পারছিল না। এরপর স্যাক্সো মনোযোগ দেন র্যাগনারের বীরগাথা বর্ণনায়, যার ফলে কিছুটা চাপা পড়ে যায় লাগার্থার চরিত্র।একদিন র্যাগনারের সাথে পরিচয় ঘটে গোৎল্যান্ডের আর্ল (সর্দার) হেরড-এর সাথে। হেরডের মেয়ে থোরা’র অনেকগুলো পোষা সাপ ছিল। একসময় সাপগুলো এত বড় হয়ে যায় যে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। বিষাক্ত প্রাণীগুলো চারদিকে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। আর্ল হেরড র্যাগনারকে প্রস্তাব দেন- সে যদি এই সাপের সমস্যা বিদেয় করতে পারে, তাহলে নিজের মেয়ে থোরাকে তুলে দেবেন তার হাতে। আর তখনই-
…থোরাকে দেখে তার মনে জেগে উঠল এক অভূতপূর্ব ভালোবাসা, কাছে পেতে চাইল তাকে। লাজেরডার জীবন থেকে সরিয়ে নিল নিজেকে; লাজেরডার উপর কাজ করছিল তার অবিশ্বাস, কারণ র্যাগনার ভোলেনি কীভাবে সে লেলিয়ে দিয়েছিল হিংস্র প্রাণী।
বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে বাঁচতে র্যাগনার পশমী পাজামায় পা মুড়িয়ে নেয়, তারপর তরুণ ফ্রিডলেইফকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে রওনা দেয় সর্পকুল ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। সাপের বংশ নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বিয়ে করে থোরাকে। ছেড়ে আসে প্রথম স্ত্রী লাগার্থাকে।তবে এসময় পাদপ্রদীপের কিছুটা আড়ালে চলে গেলেও শেষ হয়নি লাগার্থার কাহিনী। র্যাগনারের সাথে বিচ্ছেদ হবার পর সে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে, বিয়ে করে স্থানীয় আর্লকে।থোরাকে নিয়ে সংসার শুরু করতে না করতেই আবারও গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠে র্যাগনারের রাজ্যে, এবার দেশের অভ্যন্তরে শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য সাহায্য চেয়ে বার্তা প্রেরণ করে সে।
আর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে তারই প্রাক্তন সহধর্মীনি লাগার্থা। ১২০টা জাহাজ নিয়ে রওনা দেয় সাবেক অর্ধাঙ্গকে যুদ্ধ জিততে সহায়তা করতে। নৌ-বহর নিয়ে পৌঁছে দেখে যুদ্ধে লথব্রক বাহিনীর টালমাটাল অবস্থা; র্যাগনারের সন্তান সিওয়ার্ড গুরুতর আহত, যুদ্ধ জয়ের আশা নিভু নিভু প্রায়। তার তখনই ত্রাতা হয়ে আরও একবার মঞ্চে আগমন ঘটে লাগার্থার। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সে প্রবল বিক্রমে।স্যাক্সো এরপর লাগার্থার কৃতকর্মের ইতি টেনেছেন তার নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে। র্যাগনারকে যুদ্ধে সাহায্য শীল্ডমেইডেন নরওয়েতে ফিরে আসে স্বামীর কাছে। একদিন ঝগড়া করার সময় আচমকা কাপড়ের ভেতর লুকানো বর্শার ডগা দিয়ে হত্যা করে তাকে। তারপর প্রয়াত স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আসীন হয় আর্লের আসনে। স্যাক্সো গ্রামাটিকাসের ভাষায় লাগার্থা ছিল- ‘অহঙ্কারী নারী।’দুর্ভাগ্যবশত ইতিহাসবিদরা লাগার্থার মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল তা স্পষ্ট করে জানেন না। ধারণা করা হয় তার জন্ম ৭৯৫ সালে, মৃত্যু নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।লাগার্থার ইতিহাস যেমনই রক্তক্ষয়ী আর নিষ্ঠুর হোক, সে ভাইকিং যুগের অন্যতম সেরা যোদ্ধা ছিল- এটা মানতে বাধ্য হবে অনেকেই। তার মতো নিজের গুণ আর সাহসের জোরে এতদূর উঠে আসতে পেরেছিল খুব কম নারীই।
প্রাচীন নর্স পুরাণে ভ্যালকেরি নামের আরেকদল নারী যোদ্ধার কথা শোনা যায়, যাদের চরিত্রের উৎপত্তি হয়েছিল শীল্ডমেইডেনদের থেকে। নর্স পুরাণ থেকে জানা যায় ভ্যালকেরি-রা ঠিক করতো কে মারা যাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আর কে বেঁচে ফিরবে। তারপর মৃতদের অর্ধেককে তারা নিয়ে যেত ভালহাল্লায় আর বাকি অর্ধেক যেত দেবী ফ্রেয়া’র কাছে।ভালহাল্লা হচ্ছে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের উৎসব করবার হলঘর, যেখানে রাজত্ব করেন স্বয়ং ওডিন। ভালহাল্লায় পৌঁছে যাওয়া যোদ্ধাদের ডাকা হয় এনহেরেয়ার নামে। ভালহাল্লায় পানরত এনহেরেয়ারদের মদ পরিবেশন করে ভ্যালকেরিরা। র্যাগনারক তথা নর্স পুরাণ অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হবার আগ পর্যন্ত এভাবেই উল্লাসে মেতে থাকবে তারা।স্যাক্সোর লেখা জেস্টা ড্যানোরাম আর কয়েকটি নর্স-গাথা ছাড়া বৈজ্ঞানিক ভাবে যোদ্ধা মহিলাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি কিছুদিন আগেও। আগের যুগে ইতিহাসবিদরা সম্ভবত পুরুষ জাতিকে বড় করে দেখাবার মানসিকতা ধারণ করতেন বলেই অবহেলা করে গেছেন নারীদের ভূমিকা প্রমাণে। তবে দৃশ্যপট বদলে গেছে এখন। সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ইয়ালমার স্টোপল ১৮৮৯ সালে সুইডেনের বিরকা শহরে একটি কবর আবিষ্কার করেন। তখন ইয়ালমার খুব একটা মাথা ঘামাননি কবরটি নিয়ে। কারণ বিরকা শহরটি তৎকালীন ভাইকিংদের পদচারণায় মুখর ছিল। ইয়ালমারের দল ভেবে নিয়েছিল কঙ্কালটি আর কোনো উঁচু পর্যায়ের পুরুষ যোদ্ধার শেষ আশ্রয় হবে। তবে এই ধারণায় ধাক্কা লাগে ২০১৭ সালে। স্টকহোম ও আপসালা ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক উক্ত কবর থেকে পাওয়া কঙ্কালের দাঁত ও বাহু থেকে সংগ্রহীত ডিএনএ’র নমুনা পরীক্ষা করে ওয়াই ক্রোমোজমের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। আর এভাবেই ইয়ালমারের ‘পুরুষ যোদ্ধার কবর’ থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করেন গবেষকরা। কঙ্কালটির উচ্চতা ছিল উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, মারা যাবার সময় বয়স আনুমানিক ৩০ ছিল বলে গবেষকরা ধারণা করেন। মৃতদেহের পাশে বেশ কিছু অস্ত্র-শস্ত্র পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যার মধ্যে ছিল একটি তলোয়ার, তীর, ব্যাটল নাইফ, কুড়াল, বর্শা ও দুটো ঢাল। যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় প্রয়াত মানুষটি একজন যোদ্ধা ছিল।
এবার আসি বিয়ের ব্যাপারটিতে।বিয়ের আগে প্রথমে যে জিনিসটি দরকার, তা হলো দুই পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মতের মিল হওয়া। এজন্য আমাদের সমাজের মতো ভাইকিংরাও প্রথমে দুই পরিবারের সদস্যরা মিলিত হতো।কনেপক্ষের যৌতুক, বরের ধন-সম্পদের পরিমাণ যাচাই, বিয়ের তারিখ এবং বরের পরিবার বিয়েতে কনেকে কী কী জিনিস উপহার দিবে তা ঠিক করতে একত্রিত হতো দুই পরিবারের মুরব্বি গোছের লোকেরা। বরের পরিবার এবং তাদের এলাকার অন্যান্য প্রভাবশালী লোকেরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেত কনেপক্ষের কাছে, বিভিন্ন বিপদ-আপদে দিত সহায়তার প্রতিশ্রুতিবিভিন্ন বিষয়ে দুই পরিবার একমত হলে এরপর দরকার বিয়ের জন্য সুবিধাজনক দিনক্ষণ নির্ধারণ। এজন্য অবশ্য বেশ কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতো ভাইকিংরা।সাধারণত তাদের সমাজের বিয়েগুলো শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হতো। কারণ তাদের বিশ্বাসানুযায়ী সেই দিনটি বিয়ের দেবী ফ্রিজ্ঞার কাছে ছিলো পবিত্র। বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো সাধারণত এক সপ্তাহকাল স্থায়ী হতো। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসতো এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তবে শীতকালে তুষারপাতের কারণে চলাচল বেশ কষ্টসাধ্য হতো বলে তখন সাধারণত কোনো বিয়ের আয়োজন করা হতো না। বিয়েতে আগত অতিথিদের জন্য প্রয়োজনীয় থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা, অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়কালে দরকারী খাদ্য ও পানীয়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ভাইকিং সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নব দম্পতির জন্য বিশেষ এক প্রকার বিয়ার প্রস্তুতির কথাও মাথায় রাখা লাগতো।এভাবে দুই পরিবারের সদস্যদের একসাথে বসা থেকে শুরু করে বিয়ের চুড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা সারতে এক বছরের মতো সময় লেগে যেত তাদের। তবে আইসল্যান্ডে থাকা ভাইকিংদের জন্য ব্যাপারটা মাঝে মাঝে আরো দীর্ঘায়িত হয়ে যেত। প্রায় সময়ই তাদেরকে নরওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা লাগতো। ফলে সবাইকে একসাথে পেতে কখনো কখনো তিন বছরের মতো সময় লাগিয়ে দিত তারা।
ইংল্যান্ডের ১১০৯ সালের ঘটনাগুলি কার্যকরভাবে ভাইকিংদের সমাপ্তি ঘটায়। তাদের সমাপ্তির পর স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের সমস্ত রাজ্যেই খ্রিস্টান ছিল। এবং ভাইকিং সংস্কৃতিগুলো খ্রিস্টান ইউরোপের সংস্কৃতির রূপ নিয়ে ছিল। আজ, ভাইকিং বংশভুত কিছু মানুষ স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের কয়েকটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। এছাড়াও উত্তর ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং রাশিয়া সহ আরো কিছু স্থানে তাদের পাওয়া যায়।ইতিহাসের পাতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে ভাইকিং সমাজে নারীদের স্রেফ উচ্চ আসনেই স্থান ছিল না, বরং তারা সম্মান-পদমর্যাদাও উপভোগ করতো পুরুষদের মতো। আর জানতো কীভাবে প্রয়োজনের সময় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে নিজের পরিবার, সম্পদ রক্ষা করতে হয়।
লেখকঃ জুনায়েদ ইসলাম
দ্বাদশ শ্রেণী, এস ও এস হারম্যান মেইনার কলেজ কলেজে পড়ার পাশাপাশি, বই পড়তে ও মুভি দেখতে ভালোবাসেন। তবে ডিটেকটিভ সবকিছু খুব বেশি প্রিয়, নতুন কিছু জানতে এবং জানাতে তিনি সর্বদাই আগ্রহী।
লেখকের সকল লেখা দেখুন
লেখকের লিংকঃআইডি লিংক