স্বীকৃতির কড়ি - লিখেছেন - ফারজানা আক্তার মিলি
সময়টা- শীতের এক পড়ন্ত বিকেল। চারিদিকে সূর্যের আলোর লাল লাল আভা। লাল এই আভাতে গ্রামের পরিবেশ দেখতে ভালোই লাগে, যেন রং তুলিতে আকাঁ জীবন্ত ছবি।
সেই সুন্দর জীবন্ত ছবির মধ্যে গ্রামের এক পরিবারের কথা তুলছি। গ্রামের নাম শিমুলপুর। ঐ গ্রামে থাকতেন একজন মহিলা, নাম তার জমিলা খাতুন। স্বামী, সন্তান নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছিল। জন্মের পাঁচ মাস পর এক পুত্রসন্তানকে হারানোর পর, বেচেঁ থাকা একমাত্র পুত্রসন্তান কবির, স্বামী রহিম মিস্ত্রিকে নিয়ে জমিলার ছোট্ট সংসার। স্বামী মিস্ত্রির কাজ করে এবং জমিলা বাসায় বাসায় ঝি এর কাজ করে একমাত্র ছেলেকে নিবু নিবু করতে থাকা কেরোসিনের বাতিতে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ছেলে এখন মস্ত বড় অফিসার। চাকরির জন্য গ্রাম ছেড়েছে, ছেলে কবিরের নতুন যাত্রা শুরু হলো নীলফামারী শহরে। মা জমিলার আনন্দ দেখে কে! চলে যায় কয়েকটা মাস............
ছেলে গ্রাম ছাড়ার ঠিক ছয় মাস পর জমিলার স্বামী রহিম মিস্ত্রি চলে যায় না ফেরার দেশে। স্বামীকে হারানোর পর থেকেই জমিলার কোনো দায়িত্বভার নিতে চায় না গ্রামের কোনো প্রতিবেশী, এমনকি আত্মীয় স্বজনরাও। ঐ দিকে ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ছেলের কোনো খবর পায় না মা। দুঃখে- অনাহারেই দিন কাটছে গ্রামে। ঐ দিকে ছেলের অবস্থা তো বিলাসিতার পাহাড়ে যেন সোনা চকচক করছে। মার কোনো খবর তো সে নেয়ই না, অথচ মার কাছ থেকে মাসে মাসে হাত খরচের টাকাও যেমন হাতিয়ে নিচ্ছে, তেমনি অবৈধ পথে পা বাড়িয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। সে এখন অঢেল সম্পত্তির মালিক, যেন চাষির ঘরে লক্ষীর অপূর্ণ ধন।
কিন্তু মা এর মন তো আর সন্তান এর উপর থেকে দূরে সরে যেতে পারে না। গ্রামে এভাবে পড়ে থাকলে ছেলেটা খাবে কি! এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি শহরে পাড়ি দিবেন। যেমন সিদ্ধান্ত, তেমন কর্ম। চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকার অলিতে গলিতে দিনরাত ভিক্ষা করে বেড়ায়। পথের পাশে আরেক ভিক্ষুকের দেখানো পথ অনুযায়ী মাসশেষে যেটুকু আয় হয়, সেটুকু উপার্জিত আয় এক বিকাশের দোকান থেকে বিকাশের মাধ্যমে ছেলেকে টাকা পাঠান। কিন্তু ছেলে কবিরের বর্তমান অবস্থা, অবস্থান সবই তার অজানাই রয়ে থাকলো!! এভাবে কষ্ট করে পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করে মা জমিলা উপার্জন করে এবং ঐ দিকে ছেলে ঐ আয়ের উপর বেল ভেঙে পায়ের উপর পা তুলে খায়। আজ শুধু তার বিলাসিতার জোড় আছে বলে!!!! কেটে যায় এভাবে কয়েকটা বছর........
বছর খানিকটা যাওয়ার পর....... জমিলা খাতুন আজ একজন বৃদ্ধা, তেল চকচকে চামড়ায় এখন কুঁচকে যাওয়া কাপড়ের মতো, চেহারায় ভাঙ্গনের চাহনি, লড়াই করছে এক মৃত্যুপথযাত্রীর মতো। আজও তিনি পথে পথে ভিক্ষে করে যাচ্ছেন আর অকৃতজ্ঞ ছেলের কাছে আগের মতোই টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। অনেক বছর ধরেই তো ভিক্ষা করছেন তিনি, আশেপাশে অনেক মানুষ থেকে তাদের সাধ্য মতো যেটুকু সাহায্যের হাত থেকে যা পাচ্ছেন তা নিয়েই বৃদ্ধা মায়ের যাই যাই অবস্থা।
কিন্তু মৃত্যু নামক চিরন্তন সত্য থেকে কেউই রেহাই পাবে না। সময়ের পরিক্রমায় একদিন বৃদ্ধা জমিলাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যেহেতু বেঁচে থাকতে তাকে দেখবার কেউ ছিল না, সেহেতু মরার পরও তার লাশ পড়ে আছে রাস্তার ফুটপাতের উপর, মাটি দেওয়ার মতোও কেউ নেই। হঠাৎ এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে বৃদ্ধার লাশের উপর তদন্ত শুরু করেন। তদন্তকালীন খুজেঁ পায় তার শাড়ির আঁচলে পাঁচকোল করে থাকা ছোট্ট মুঠোফোন, যেটার মাধ্যমে তিনি তার একমাত্র ছেলের কাছে টাকা পাঠাতেন। বিকাশের দোকানি থেকে তথ্য পাওয়ার মাধ্যমে খুঁজে পান ছেলে কবিরের ফোন নম্বর। মা এর মৃতদেহ ছেলের কাছে হস্তান্তরের জন্য পুলিশ সদস্য কবিরকে ফোন দিলেন।
-হ্যালো, পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। একজন মৃত বৃদ্ধা মহিলার মুঠোফোন থেকে আপনার নাম্বার সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত বৃদ্ধা মহিলা কি আপনার মা?
- না, না... ইনি আমার কেউ নন।
-কিন্তু ওনার মুঠোফোনেই তো আপনার মোবাইল নম্বর, বিকাশ নম্বর পেয়েছি আমরা।
- (রাগান্বিত স্বরে) কি বলছেন আপনি? নাম একই থাকতেই পারে, দুনিয়ায় কী কবির নামে আমি একজনই আছি নাকি?(আমতা আমতা করে)
সত্য অস্বীকার করে কবির পুলিশের মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিলেন। একদিন পর......... পুলিশ আবারও বৃদ্ধার ছেলেকে ফোন দিলেন।
-গতকাল আমরা তদন্ত করে পেয়েছি যে, মৃত বৃদ্ধার কাছে ৩,০০০ টাকা জমা আছে এবং ঐ টাকাগুলো ছেলে কবিরের কাছে পাঠানোর কথা ছিল বলে জানা গেছে। আমি আবারও নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি তার ছেলে? পুলিশের কাছে টাকার কথা শুনে কবির সাহেবের কথার সুর পাল্টে যায়।
- জ্বি, জ্বি, আমিই মৃত বৃদ্ধার ছেলে। আমি নীলফামারীতে থাকি। আমার কাছে শীঘ্রই টাকাগুলো পাঠানো হোক।
হায়রে কপাল! মা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন। এটাই কি ছিল ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে নিবু নিবু প্রদীপে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার ইচ্ছের দাম? এটাই কি ছিল শহরের পথে পথে যাযাবরের মতো ঘুরে ভিক্ষা চেয়ে ছেলের কাছে টাকা পাঠানোর প্রতিদান!! সবই কি তাহলে টাকার খেলা!!!! টাকা কি এতই নিষ্ঠুর যে একদল তাকে আয় করছে সৎ পথে আর আরেকদল কাছের সম্পর্কের বাঁধন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় ব্যয় হচ্ছে!! প্রকৃত অর্থে, বৃদ্ধা মা জমিলার কপালে এ প্রতিদানই লেখা ছিল!
(সমাপ্ত)
+লেখক: ফারজানা আক্তার মিলি
হলিক্রস কলেজ এ অধ্যয়নরত ছাত্রী। ভালোবাসে স্বপ্ন দেখতে, কাজ করে সেই স্বপ্ন পূরণে। আশা করেন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার।
ফেসবুক আইডি:আইডি লিংক