রাতুলের অসমাপ্ত ডায়েরীর পাতা থেকে - লিখেছেন - ফাহিম আজমল
আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন সময়, ছোটবেলাটা কেটেছে এক মফস্বল শহরে। শহর বললে ভুল হবে, আদতে গ্রামই বলা যায়। শহর বললে যে রকম একটা বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার চলে আসে, এরকম ছিলো না আমাদের শহরটা। আর যে কেউ এটা মেনে নিবেন যে, গ্রামের ঈদ উদযাপন হচ্ছে প্রথম প্রেমিকার মতো! একবার যে গ্রামে ঈদ উদযাপন করেছে সে যদি কোনো কারণে আর গ্রামে ঈদে আর নাও আসতে পারে তবুও সেই স্মৃতি সে ভুলতে পারবে না। শহুরে জীবনে অবশ্যই চাকচিক্য আর মরীচিকারূপে আনন্দ পাওয়া যেতে পারে হয়ত, তবু যেন কিসের একটা অভাব, গ্রামের সাথে! খুব সম্ভবত একে মায়া বলে! ছোটবেলাটা অনেক আনন্দঘন ছিল, নানাবিধ কারণে। আমরা একসাথে একটা দল বেঁধে সবসময় ঘুরতাম। আনিসুল হক এর 'দুষ্টু ছেলের দল' ছিলাম। পাড়ার সবাই আমাদের দুষ্টুমিতে তটস্থ থাকত। আমাদের জমির চাচা, যার বাসার সবকটা জানালা আমাদের ক্রিকেট বলের আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত। আমরা চাইলেই মাঠে খেলতে পারতাম। কিন্তু আমরা জমির চাচার বাড়ির সামনেই খেলতাম, কারণ চাচার একটা মেয়ে ছিল, আমাদের বড় আপু, শ্রাবণী। খুব চমৎকার দেখতে! আমার দেখা প্রথম কোনো সুন্দরী মেয়ে! তখন বয়স কত ছিল আমাদের? আট কি নয় হয়ত!
জমির চাচার বাসার সামনে খেলতাম কারণ শ্রাবণী আপু আমাদের খুব পছন্দ করত। শ্রাবণী আপুর ছোট ভাইও আমাদের সাথেই খেলত। আবার শ্রাবণী আপু ছিলেন আমার মেজো আপুর ক্লাসমেট। এই সুবাদে আমাদের মাঝে মাঝে শ্রাবণী আপুর সাথে বাসায় গিয়ে দেখা করার সুযোগ হত। তখন আমাদের তিনি খুব আদর করতেন। বড় আপুরা একটু স্নেহপরায়ণ হয়ে থাকেন।
ছোটবেলায় যার আচার ব্যবহারে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছি তিনি হচ্ছেন পাভেল ভাই। আমার চেয়ে হয়ত দুই-এক বছরের বড়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি আমাদের দুষ্টু দলের সর্দার হয়ে যান! এর কারণ হয়ত এই, একই ক্লাসে তার তিন বছর অবস্থান করা। আমি যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হই, তখনো তিনি ক্লাস ফোর এ ছিলেন, আমি যখন ক্লাস ফোর এ উঠলাম তখনো তিনি উক্ত শ্রেণির শেষের আসনটি অলংকৃত করতেন! খুব স্বাভাবিক ভাবেই, এরকম "অকম্মা" ছেলের প্রতি কারো আগ্রহ থাকার কথা নয়। কোনো এক অজানা কারণে পাভেল ভাইয়ের সাথে আমার সখ্য হয়ে গেল! চারদিকে রব উঠল 'অকম্মা' এর সাথে মিশে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে নষ্ট হতে চলল বলে! আমি তাদের কথায় পাত্তা দিতাম না। এই ভাইয়ের কাছে আমি অনেক ঋণী। পাভেল ভাইই ছিলেন আমার 'নিষিদ্ধ ফলের' জ্ঞানের গুরু! এছাড়াও তার অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি আমাদের কয়েকজনকে মাঠের মধ্যে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে 'আর্ট' শেখাতেন। বলতেন "দ্যাখ! অভিনয় শেখা যায় না, অভিনেতার জন্ম হয়! এই আমাকে দ্যাখ, আমি যে কথা বলছি, এর ভেতর কি পাচ্ছিস জানিস, "আর্ট"। অভিনয় শিখতে হলে তোমাকে আর্টের চর্চা করতেই হবে।" আমরা বাকী বন্ধুরা শুধু কথা শুনে হাততালি দিতাম আর মাথা ঝাঁকাতাম! পাভেল ভাই আমাদের ব্যাচমেট হলেও আমরা তাকে ভাই বলে ডাকতাম। 'ভাই' ডাকটা ছিল তাচ্ছিল্যে আর শ্রদ্ধা দুইটা বিপরীত অনুভূতির একই বহিঃপ্রকাশ। কি অদ্ভুত! ছোটবেলা এমন অসংখ্য চমৎকার অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিল। কিন্তু পৃথিবীটা চলে রোলার কোস্টারের নিয়মে। আর আমরা এর বাহক।
আমার এই আনন্দময় ছোটবেলায় ও দু:খের ধারাপাত হলো। রমযান মাস শুরু হয়েছে কেবল। বাবা কাজের সূত্রে ঢাকা থাকতেন তখন। বিদ্যুত অফিসের সহকারী অফিসারের পদে কাজ করতেন। চাকরীসূত্রে তিনি প্রায় সারা বছরই ঢাকায় থাকতেন। রমযান মাস এলেই আমরা ভাই বোনেরা চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকতাম যে বাবা কবে বাড়ি আসবে। এর পেছনে আমাদের কিছু লোভনীয় উদ্দেশ্যও আছে। কারণ,প্রতি ঈদের আগে বাবা বাড়ি আসার আগে আমাদের তিন ভাই বোনের জন্য ঢাকার নিউমার্কেট থেকে ঈদের শপিং করে আনতেন। বাবা বাড়ি পৌঁছালেও আমরা সেই নতুন জামা কাপড় হাতে পেতাম না। ঈদের দিন বিছানায় ঘুমন্ত থাকাবস্থায়ই সবার নতুন জামাকাপড় মাথার পাশে রেখে দিতেন। এটাই আমাদের বাড়ির নতুন জামাকাপড় পাওয়ার পদ্ধতি! আমরা তিন ভাই বোন তাই বাবার জন্য অপেক্ষা করছি।
রমযানের মাঝামাঝি সময়। বাবা হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। পরিবারের সবাই যারপরনাই অবাক। এমনকি মা ও বিষয়টা জানতেন না। তবে আমি আর আমার ছোট বোন কিন্তু অনেক খুশি! বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি আসাতে না যতটা, তার চেয়ে আমাদের ঈদের নতুন পোশাক এখন বাড়িতে আছে এবং তা অতি নিরাপদে তা ভেবেই আমাদের মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করতে লাগল! বাবা বাড়িতে এসেছেন প্রায় চার-পাঁচদিন হয়ে গেল।একদিন রাতে তিনি আমাদের সব ভাইবোনকে রাতের খাবারের জন্য আসতে বললেন। সবাই খাওয়া শুরু করলাম। খাওয়া ধীরেসুস্থে শেষ করে তিনি আমাদের সোফায় বসতে বললেন। বাবা তার খাওয়া শেষ করে আমাদের সবাইকে যা বললেন তা শুনে আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এই 'কোনো এক অজানা কারণে তার চাকরি চলে গেছে। তিনি আর ওই চাকরিতে ফিরে যাবেন না। তিনি বেতন না নিয়েই রাগ করে চলে এসেছেন। এবারের ঈদে আমাদের জন্যে নতুন জামাকাপড় কিনতে পারেননি।" বাবাকে আমরা সবাই বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই জানতাম।তাকে আবেগ স্পর্শ করে না। কিন্তু কেনো যেন মনে হলো এই কথাগুলো বলার পর বাবার গলা ধরে এসেছে!!
ছোটবেলার একটা সুবিধা আছে। কোনো কষ্টই দীর্ঘস্থায়ী হয় না! ছোটদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। এরাও কষ্ট পায়। তবে কষ্ট পেলেও তা ভুলে নতুন একটা আনন্দের কাজে তারা পেতে থাকতে পারে। বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় আমার প্রথমে কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে তা ভুলে গেলাম। তবে ঈদের জামাকাপড় পাওয়া হবে কি না তা নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। তাও মনে মনে একটা আশা ছিল যে,বাবা হয়ত ঠিকই শেষ মুহুর্তে নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়ে আমাদের সবাইকে চমকে দিবেন!
ঈদের মাত্র দু-একদিন বাকী। আমরা সব ভাইবোন আশায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে, বাবা হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, এর কোনো সম্ভাবনাই নেই, আমি আর আমার বড়ভাই বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। কারণ, আমরা জানতাম, আমাদের পরিবার বাদে সবাই ঈদের নতুন পোশাক কিনে ফেলেছে। কেউ কেউ তিন-চার সেট পর্যন্ত! পৃথিবীটা খুব আজব জায়গা, কারো কারো চাহিদাই অপূর্ণ রয়ে যায়, আবার কারো হয় বিলাসিতার জয়জয়কার! আমি কল্পনা করছি তখন, আমার বন্ধুরা তাদের নতুন জামা লুকিয়ে রেখেছে। গভীর রাতে সেই বন্ধু ওয়ারড্রোব খুলে তার নতুন জামাটা সবার চোখের আড়ালে থেকে দেখছে, ঘ্রাণ নিচ্ছে! আবার লুকিয়ে রাখছে। ঈদের জামাটা সবার জামার থেকে আকর্ষণীয় হওয়া চাই এমন একটা ভাব!
ঈদের আগের রাত। চাঁদ রাত। আতশবাজির শব্দ হচ্ছে। খুশি খুশি একটা ভাব চারিদিকে। আমিও কিছুক্ষণ ছাদে আতশবাজি ফুটিয়ে আমার শোয়ার ঘরে চলে আসলাম। আমার আর ভাল্লাগছে না। আমি শুধু ভাবছি কালকে যখন আমার সব বন্ধুবান্ধব নতুন জামাকাপড় পরে আমাদের বাড়ি আসবে আমাকে নিতে, আমি তখন কি করব! তাদের নিত্যনতুন উজ্জ্বল পোশাকের ভীড়ে আমাকে তখন কি ম্রিয়মাণ দেখাবে না! ভাবতে ভাবতে কান্না চলে আসল। হঠাৎ কখন যে আমি ঘুমিয়ে পরলাম আমার খেয়াল নেই।
খুব সম্ভবত সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। পৃথিবীতে এমন অনেক কষ্ট আছে যা কাউকে বলা যায় না, শুধু রাতের বালিশটাকে সঙ্গী করা ছাড়া! দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে তো আর পৃথিবীর কঠিন রূপ বা বাস্তবতা সম্পর্কে এত ধারণা রাখে না।তাই হয়ত..!
ঈদের দিন। আমার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে। একবার শুধু ছাদে গিয়ে দাড়ালাম। দেখলাম, শ্রাবণী আপু তার ছোট ভাই কে নিয়ে আমাদের বাসায় আসছে। আমার তখন শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। আমি ভেবে চলেছি, কোনো ভাবে যদি আজকের দিনটাতে অসুস্থ হয়ে যেতে পারতাম, বলতে পারতাম, বন্ধু তোদের সাথে ঘুরতে যেতে পারব না রে, অনেক জ্বর আমার! একশো চার! কেউ বুঝতে পারত না। ইতোমধ্যেই পাভেল ভাইয়ের কাছ থেকে জ্বর আনানোর গুপ্ত বিদ্যা রপ্ত করেছি। বগলের নিচে একটা রসুন দিয়ে রাখলেই না কি দুই-তিন ঘন্টার জন্য একটা জ্বরের ফিলিংস আসে! আমি তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গেলাম। গিয়ে তন্ন তন্ন করে রসুন খুঁজলাম। একটাও রসুন পেলাম না! পাবো কি করে, রসুন লাগে পোলাও -গরুর মাংস রান্না করতে! আর এই খাদ্য আমাদের বাড়িতে শেষ কবে রান্না হয়েছিল, আমি তা ভুলে গেছি! অগত্যা আমি পেঁয়াজ নিয়ে আসলাম। এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। ততক্ষণে শ্রাবণী আপু আর তার ভাই চলে এসেছে। মেজো আপুর সাথে শ্রাবণী আপু কথা বলছে, আমি শুনতে পারছি। মেজো আপু শ্রাবণী আপুকে বললেন, “তোরা বস, তোদের জন্য শেমাই নিয়ে আসি্” “আরে নাহ,পাগল নাকি! বাসা থেকে খেয়ে মাত্র বের হলাম।” “তাও একটু খা, অল্প করে ” “নাহ,এখন খাওয়া অসম্ভব!” ভাগ্যিস! আপু নিষেধ করেছিলেন। সেদিন আমাদের বাসায় শেমাইও রান্না হয় নি! শ্রাবণী আপু আর তার ছোট ভাই আমাকে খুঁজছিলেন। কিন্তু আমার মেজো আপু আমার ব্যাপারটা জানতেন। মেজো আপু বলল, রাতুল ঘুমোচ্ছে, হাহাহা, অলস ছেলে কি না! ঈদের দিনেও ঘুমায়!
শ্রাবণী আপু কিছু বললেন না, হয়তো কিছু একটা ভেবে চলে গেলেন! ঐদিকে পেঁয়াজ দিয়ে জ্বর আনানোর প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়ে আমি বসে আছি। একটা রসুন যদি থাকত! তবে জ্বর না এলেও মাথায় তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে জ্বর জ্বর একটা ভাব আসত। আর বাকীটা 'মধ্যবিত্তীয়' অভিনয় দিয়ে চালিয়ে নেয়া যেত। মধ্যবিত্ত মানুষ আর কিছু পারুক না পারুক, অভিনয়টা দারুণ করতে পারে! দশ বছরের একটা বাচ্চা কি আর এত কষ্ট সহ্য করতে পারে! নিচ থেকে হঠাৎ আমার নাম ধরে কেউ ডাক দিল। এই কন্ঠটা আমার পরিচিত। পাভেল ভাই! এর ডাক আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম, আমার বন্ধু পাভেল ভাই, রাসেল, সজীব, জুয়েল, আকরাম আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। পাভেল ভাইয়ের পাশে শ্রাবণী আপুর ছোট ভাই, জামিল! আমি আরো অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, সবাই তাদের পুরনো জামা পরে এসেছে। কিন্তু, আমি নিশ্চিত এরা সবাই নতুন ঈদের জামা কিনেছে।পাভেল ভাইয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলাম, তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন! আমার আর বুঝতে বাকী রইল না! বারান্দা থেকে রুমে এলাম। আমার পুরোনো গেঞ্জিগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায় সেই গেঞ্জিটা পরলাম। আর সবচেয়ে ভালো প্যান্ট পরলাম, তবে একটু সতর্ক থাকতে হবে কারণ, প্যান্টের বিশেষ জায়গা দিয়ে একটু ছিদ্র আছে, তবে সতর্ক থাকলেই হয়!
আমি নিচে নেমে এলাম। সবাই পুরোনো জামা-প্যান্ট পরে এসেছে। আরো খেয়াল করলাম, কেউ আমার পোশাকের দিকে খেয়াল করছে না। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। সারাদিন অনেক মজা করেছি। আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন! সেবারের ঈদের মত ঈদ আমি আর কখনো কাটাই নি। এরপর সব ঈদেই নতুন পোশাক পরেছি। তবে সেই ঈদ এর কথা আমি ভুলতে পারব না। পৃথিবীটা অদ্ভুত আর এর মানুষগুলোও। এরকম অদ্ভুত আর মায়া আছে বলেই পৃথিবীটা এত ভালো লাগে!
+লেখক: ফাহিম আজমল
ঢাকা কলেজ এর এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ভালোবাসে ক্রিকেট খেলতে। এছাড়াও পড়তে, পড়াতে, শিখতে, লিখতে।
ফেসবুক আইডি:আইডি লিংক