আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, "বলুন তো, এই বাংলা অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রথম কবে এসেছিলো?"

আপনি হয়তো বলবেন, মধ্যযুগে বা একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে।

আবার অনেকেরই ধারণা বঙ্গ অঞ্চলে ইসলামের প্রথম গোড়াপত্তন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে; এবং তুর্কী মহাবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামের গোড়াপত্তন ঘটে। কারো কারো মতে হযরত শাহজালাল (রঃ) প্রথম এই অঞ্চলে ইসলামের আলো ছাড়িয়েছিলেন।

আসলেই কি তাই?

না! প্রথাগত ইতিহাস অনুযায়ী ১১- ১৩ শতকে সর্বপ্রথম সুফি মুসলিমদের আগমন ঘটেছিলো চট্টগ্রামে। এর আগে ইসলামের সাথে এ অঞ্চকের তেমন যোগসূত্র পাওয়া যায় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ের অবাক করা প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস বলছে এদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন হয় ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে!! চলুন সংক্ষেপে জেনে নেই সেই ইতিহাস।


শাহনামার পান্ডুলিপিতে অঙ্কিত কাদিসিয়ার যুদ্ধ চিত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ

হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর উপর তখনও সম্পূর্ণ কুরআন নাজিল হয়নি! এ অঞ্চলে তখন ছিলো রাজা শশাঙ্কের শাসন। মুহাম্মাদ (সঃ) এর মামা সম্পর্কিত (মা আমেনার চাচাতো ভাই) আবু ওয়াক্কাস কিংবা সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুরের লালমনিরহাটে আগমন করেন। আবু ওয়াক্কাস ছিলেন আব্রাহামীয় ধর্মবিশ্বাসের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর অন্যতম সাহাবা (সাথী)। তিনি ১৭ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ৬৩৬ সালে পারস্য বিজয় ও শাসনের জন্য তিনি সমাধিক পরিচিত। আনুমানিক ৫৯৫ সালে মক্কা নগরে কুরাইশ বংশের বনু জুহরাহ গোত্রে তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পিতার নাম আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে উহাইব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে জুহরাহ এবং মা হমনা বিনতে সুফিয়ান ইবনে উমাইর ইবনে আবদ শামস ইবনে আব্দে মানফ।

ইতিহাস থেকে জানা যায় ৬১৬ এবং ৬৫১ সালে তাঁকে ইসলামি সাম্রাজ্যের কুটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে চীনে প্রেরণ করা হয়। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার নৌ-রুটে চীনে যাওয়ার সময় তিনি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে থামেন এবং বাংলা অঞ্চলের বাসিন্দাদের মাঝে প্রথমবার ইসলাম ধর্মের সাথে পরিচয় ঘটে। ধারনা করা হয় ৬২০ সালেই তিনি লালমনিরহাটে গমন করেছিলেন এবং সেখানকার কিছু স্থানীয় বাঙালী প্রথমবারের মতো ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন!

 


আবু আক্কাস মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি ও টেরাকোটা

নব্য মুসলিমদের উপাসনার জন্য সেখানে নির্মান করা হয় এই অঞ্চল তথা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। তাঁর সমসাময়িক সময়ে নির্মিত বৃহত্তর বাংলার সর্বপ্রথম মসজিদ এর ধ্বংসাবশেষ লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের মজেদের আড়া গ্রামের জঙ্গলে আবিষ্কৃত হয়েছে, ১৯৮৭ সালে! এই মসজিদের ঐতিহাসিক নাম 'আবু আক্কাস মসজিদ' এবং 'সাহাবায়ে কেরাম মসজিদ'। প্রত্নতাত্ত্ববিদদের ধারণা এটি ৬৪৮ (কারোর মতে ৬৮০- ৯০) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিলো! ৬২৮ সালে ভারতের কেরালায় নির্মিত চেরামান জামে মসজিদের পর এটিই উপমহাদেশে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ! মসজিদের ধ্বংসাবশেষের একটি ফলকে স্পষ্টাক্ষরে কালিমায় তাইয়্যেবাহ এবং ৬৯ হিজরি সাল লিখা আছে। অর্থাৎ ৬৯ হিজরিতে এই মসজিদ নির্মাণ কিংবা সংস্কার করা হয়েছিলো! শিলালিপিগুলো বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ আমাদের এই মাটিতে ইসলামের ইতিহাস বহু পুরনো। বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের ৬'শ বছর আগেই এদেশে ইসলাম ধর্ম এসেছিলো!


তথ্যসূত্রঃ (উইকিপিডিয়া, বই: রংপুর জেলার ইতিহাস; পৃ: ১২৬, মতিউর রহমান বসুনিয়ার লিখিত গ্রন্থ: রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত

শাহরিয়ার রিফাত সরকার
আমি শাহরিয়ার রিফাত সরকার। ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। অতি ক্ষুদ্র এক পাঠক। লিখতে ভালোবাসি, ভালোবাসি দেশমাতাকে!