নানা কারণে ভারবর্ষের ইতিহাস নির্মাণ করার কাজটি দূরহ। এর মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত 'বাংলা' অঞ্চলের সমৃদ্ধ অতীত, কাজটির জটিলতাকে নিয়ে গেছে একটি নতুন মাত্রায়। তাই আধুনিক বাংলাদেশের শেকড় সন্ধান পূর্বক, সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস দুই মলাটে লিপিবদ্ধ করার সাহসী কাজটি শেষ করেছেন হাতে গোনা কয়েকজন পন্ডিত। এরূপ কাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য উইলিয়াম ভ্যান স্যান্ডেলের 'A History of Bangladesh' বইটি। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত ২০০৯ সালের এই বইটি বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পর্কে একটি কার্যকর সংক্ষিপ্ত ধারণা পাঠকের সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। 




A History of Bangladesh বইটি ৩৩০ পৃষ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অবশ্য পাঠ্য ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠভাবে সংরক্ষণ করেছে। বইটির ভালো বিষয় এই যে, লেখক নিজে তার কাজের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস সূত্রতার কথা উপস্থাপন করেছেন। যার ফলে চাইলেও লেখককে খুব সংক্ষিপ্ত কাজ করতে হয়েছে। 


প্রাক-লিখন যুগ থেকে আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রা কখনোই একরৈখিক সরল পথ অনুসরণ করেনি। নতুন বদ্বীপ হিসেবে আমাদের বিশাল সমতলে মানুষের বিচরণ ও অন্যান্য কর্মকান্ডের সিংহভাগ আমাদের আজও অজানা। তারওপর জানা বিষয়াদি সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্তে রয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা। সবকিছু বিবেচনা করে উইলিয়াম স্যান্ডেল আমাদের সমগ্র ইতিহাসকে ধাপে ধাপে অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে অবস্থান করে সরাসরি দেশটির পন্ডিত বর্গের সান্নিধ্যে বইটি রচনা পাশাপাশি- পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত এবং ছবি সংযোজনের ফলে বইটির গ্রহণযোগ্যতা জ্ঞানপিপাসু মহলে খুবই বেশি।


বইটির আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার পূর্বে, আমাদের উল্লেখ করা প্রয়োজন বইটির সময়সূচী বা টাইমলাইন পর্বটিকে। লেখক প্রথমেই ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহৎ ঘটনাগুলোকে একনজরে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। এখানে রয়েছে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের স্থপতি মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাইজ পাওয়া থেকে শুরু করে ১৯৫৫ সালে 'বাংলা একাডেমীর' প্রতিষ্ঠা স্মৃতির স্মরণিকা। সেখান থেকে লেখক লিখিত ভূমিকা অংশে বইটি লেখার প্রয়োজনে তার ব্যবহৃত মেথড বা কর্মপন্থা নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা লিখেছেন। বাংলা ভাষাকে রোমান হরফে লেখার জটিলতা তিনি কিভাবে সমাধান করেছেন তার ইঙ্গিত এখানে উপস্থিত। 


সমগ্র বইটিকে স্যান্ডেল পাঁচটি অংশে ভাগ করেছেন। প্রথম অংশে স্যান্ডেল আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলের ভৌগোলিক সত্তা, জলবায়ুর বৈচিত্র্যময়তা, বনভূমি থেকে নগর সভ্যতার গোড়াপত্তন ও ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস খুব সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। প্রথম অংশের একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ অঞ্চলে রিচার্ড ইটনের তত্ত্বানুসারে ইসলামের বিস্তার, ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের প্রাথমিক আগমন এবং তৎকালীন আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক তাৎপর্য। দ্বিতীয় অংশে সাম্প্রতিক সময়ের উপনিবেশিক ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। মুঘল শাসন থেকে ব্রিটিশ শাসন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, নীল চাষ, দুর্ভিক্ষ, কলকাতার উত্থান ইত্যাদির মতো ব্রিটিশ শাসনের নানা উপজাত নিয়ে এই অংশে আলোচনা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের ঘটনাবহুল ইতিহাসকে খুব দ্রুত লেখক ভারত ভাগে শেষ করেছেন, যেখান থেকে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্মে প্রবেশ করে বইটির পাঠকেরা। 




বইটির তৃতীয়াংশে গত অধ্যায়ের সূত্র ধরে পাকিস্তানের জন্ম বিষয়ক মৌলিক আলোচনাগুলো করা হয়েছে। ভাষা নিয়ে সংকট, পাকিস্তানের জন্মলগ্নের শুরুর ভোটাভুটির রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে আচমকা স্বৈরশাসনের প্রহসন বইটিতে দক্ষতার সাথে প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের শুরুর কথা এবং আমাদের অতিপরিচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিও এ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে। আমার মতে এই অংশের শেষ চারটি অধ্যায় আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগের দাবি রাখে যেহেতু ইতিহাসের বাইরেও এখানে ব্যাখ্যা ধর্মী আলোচনায় পাকিস্তানের সামাজিক- সাংস্কৃতিক- অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিদেশী অনুদান নির্ভর উন্নয়ন চরিত্রকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। বইটির চতুর্থ অংশে আমাদের দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭১ পরবর্তী প্রাথমিক ইতিহাস স্যান্ডেল লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের নানা বিতর্কিত রাজনৈতিক ইতিহাস অনুসরণের জন্য চমৎকার একটি বস্তুনিষ্ঠ দলিল হতে পারে বইটির এই অংশটি। তবে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃখজনক হত্যাকান্ড সম্পর্কে বইটিতে খুব কম আলোচনা হয়েছে। যা বইটির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হিসেবে আমি মনে করি। 




বইটির শেষ অংশ বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট অতীত নিয়ে হওয়া সর্বাপেক্ষা ভালো কাজগুলোর একটি। এই অংশে বিস্তারিতভাবে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপর্বগুলোকে নানা আঙ্গিক ও মাত্রায় আলোচনা করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসন, নতুন করে গনতন্ত্রের পুনর্যাত্রা, ধর্মীয় উন্মাদনার জোয়ারের শুরুর কথা, চট্টগ্রামের পাহাড়ে সশস্ত্র সংকট, জাতীয় রাজনীতির দর্শন ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। একটি ভেঙ্গে পড়া দেশ ও সমাজ থেকে নতুন করে বাংলাদেশের যাত্রা, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অর্জন, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিল্পায়ন থেকে শুরু করে পানি, শক্তি, পরিবেশের প্রতি বিশাল জনসংখ্যার হুমকি পাল্টা হুমকি নিয়ে এ অংশটির অধিকাংশ অংশ সাজানো হয়েছে।  সর্বশেষে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক গন্তব্য নিয়ে ধারণাগত কাঠামো উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে উইলিয়াম ভ্যান স্যান্ডেল তার বইটি শেষ করেছেন। বইটির উপসংহার পর্বের মতো বলতে হয় যে, এই বইটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে পাখির চোখে দেখতে চেয়েছে। অনেক জরুরি আলোচনা হয়তো সেভাবে বইটিতে প্রাধান্য পায়নি, তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ ও সামগ্রিক ঐতিহাসিক ধারণা পেতে বইটি তুলনাহীন।