সক্রেটিস


ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বিচার হয়তো সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড। এবং সক্রেটিস চাইলেই সেই মৃত্যুদন্ড এড়িয়ে যেতে পারতেন। তবে তিনি তাঁর দার্শনিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন। এই মৃত্যুদন্ডের পিছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণ আছে। আছে দর্শনশাস্ত্রের দারুণ কিছু সমস্যার ইঙ্গিত। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এখানে মহান হয়ে আছে, আদালতে সক্রেটিসের কথোপকথন। যা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে শিষ্য প্লেটো রচিত নাটকীয় সংলাপগ্রন্থ "অ্যাপোলজি" -তে। আদালতে সক্রেটিসের বয়ান থেকে তার দর্শনের মূলসূত্রগুলো জানা যায়। ইতিহাসের নানা কালপর্বের পরে আজও এই দার্শনিক ভিত্তিগুলো আমাদের জন্য অনুধাবন করা জরুরী।  




দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরে দৈববাণী হয়েছিলো যে, জীবিতদের মধ্যে সেসময় সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ ছিলেন সক্রেটিস। তিনি এটি অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উত্তর যুক্তিতর্কের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন, যারা নিজেদের জ্ঞানী দাবি করে বা সমাজ যাদের জ্ঞানী দাবি করে তাদের জানাশোনায় ঘাটতি আছে। তবে এর মাধ্যমে সক্রেটিস নিজেকে কোনোদিন চূড়ান্ত জ্ঞানী দাবি করেননি। তিনি নিজের প্রজ্ঞা থেকে বলছেন যে, কেউই জ্ঞানী নয়। অন্তত নিজের বেলার তিনি জানতেন যে, তিনি কিছু জানেন না। এহেন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দৈব বাণীর বিরুদ্ধে বলে ধর্মদ্রোহী হয়ে ওঠেন।




সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞান ও সত্য চর্চার মাধ্যমে আত্নার উন্নয়ন বা পরিচর্যা করতে হবে। তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "আমি এথেন্সের ছোট-বড় সবাইকে বলি-- তোমরা তোমাদের শরীর কিংবা অর্থের পিছনে ছুটো না, তোমাদের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত আত্নার উন্নয়ন সাধন। যত দিন সত্য ও জ্ঞানের খোঁজ না পাও ততদিন পর্যন্ত অর্থ, যশ বা প্রতিপত্তির চিন্তা কোরো না"। দাবি করা হয়েছিলো, এ ধরণের দর্শন প্রচারের মাধ্যমে সক্রেটিস তৎকালীন যুব সমাজকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করছেন।




সক্রেটিসে সমালোচনা এবং ভর্ৎসনাগুলো শাসকগোষ্ঠীর জন্য অনেক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে তিনি বলেছেন এই সমালোচনাগুলোই রাষ্ট্রের জন্য উপকারী। কারণ রাষ্ট্রকে চাঙ্গা রাখতে এই হুল ফোটানো যুক্তিতর্কের কোনো বিকল্প নেই। এই কথা প্রযোজ্য হতে পারে একজন মানুষের ক্ষেত্রেও। স্পষ্টভাষায় বিবৃত উপদেশ ও সমালোচনা উভয়ই মানবজীবনে কল্যাণ বয়ে আনে।




সক্রেটিসের বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হচ্ছে: 'জ্ঞানেই পুণ্য'। সক্রেটিস মনে করতেন, কেউ স্বেচ্ছায় কুকর্ম করে না। ভালোকে জানার পর কেউ মন্দকে বেঁছে নেয় না। এজন্য মানুষকে গভীরভাবে মানবচরিত্র বুঝতে হবে। মানুষের জন্য কী ভালো, কিসে মানুষের সুখ, তার জীবন যাপন পদ্ধতি কী হওয়া উচিত- এসব অনুধাবনের জন্য মানুষকে গভীর অধ্যয়ন করতে হবে। এই চিন্তাধারা থেকেই সক্রেটিস ঘোষণা দিয়েছিলেন যে: "অপরীক্ষিত জীবন ভালো জীবন নয়"।


📖 তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা: প্লেটো | দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তা | গোলাম ফারুক