স্মৃতির শহর - লিখেছেন - মেহেদী হাসান রাব্বি
শাহারিয়ার বাইপাসের রাস্তাটা ধরে হাঁটছে। ঠিক চারটার দিকে তার একটা টিউশন আছে। টিউশনি বলতে একটা মাত্র ছাত্র পড়ায় শখের বশে । দু'দিন ধরে পড়াতে যায় না শাহারিয়ার। তাই আজ যত লেইট ই হোক না কেন যেতে তাকে হবেই। কিন্তু যাওয়ার পথেই শাহারিয়ারের মনে পড়ে যে তার ছাত্র তো গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। গতকাল রাতেই তাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কথাটা তার স্মরণে ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে। কারণ প্রতিদিনই শিশিরের সাথে দেখা করতে লেইট হয়.. আজ আর হবে না। বরং আজ ঘন্টাখানেক আগেই তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলেজের পার্কটার দিকে পা বাড়ায় শাহারিয়ার। পার্কটাতে ঢোকার আগে একটা লাল গোলাপ কিনে নেয় শাহারিয়ার। পার্কটাতে ঢুকে ডান দিকে যেতেই কয়েকটা বসার সুন্দর বেঞ্চ আছে। সেখানে প্রথম বেঞ্চটাতে বসে শাহারিয়ার। পার্কটা তার কাছে বেশ পরিচিত। কিন্তু মজার বিষয় হলো সে পার্কটার মাঝে প্রতিনিয়ত নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে বেশ কয়েকবার শিশিরের সাথে আলোচনা করেছে সে। প্রতিবারই শিশির বলেছে প্রকৃতি প্রেমিরা নাকি প্রতিনিয়ত প্রকৃতির মাঝে রহস্য খোঁজে, তাই চেনা প্রকৃতিও তাদের কাছে নতুন হয়ে হঠে। এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না শাহারিয়ার। বেশ মগ্ন হয়ে পার্কটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ কাঁধে হালকা ধাক্কা অনুভব করে শাহারিয়ার। পিছন ফিরে তাকায় সে __
- কে! ও তুমি..
- হ্যাঁ, মশাই আমি। (কথাটা বলতে বলতে শিশির শাহারিয়ারের পাশে বসে)
- আজ ঠিক সময়ে.. ব্যাপার কি?
- টিউশনটা করানো হয় নি তো, তাই অনেক আগে থেকেই বসে আছি।
- আমাকে জানাতে পারতে। আগেই চলে আসতাম।
- হুম পারতাম কিন্তু অপেক্ষার অনুভুতি আলাদা। তাই সুযোগ পেয়ে আর হাত ছাড়া করিনি।
- তো কেমন অনুভব করলে তোমার অপেক্ষার অনুভূতি?
- ভয়ের অনুভব।
- ভয়?
- হ্যাঁ ভয়..
শিশির একটু রাগ করেছে না, বেশ খানিকটা রাগ করেছে। রাগ করলে তার সুন্দর গাল দুটো ফুলে ওঠে। এখন তার গাল দুটো ফুলেই আছে। মনে মনে ভাবছে সে বাঘ না ভাল্লুক যে তার আগমনে শাহারিয়ার ভয় পাবে। রাগ মাখা কন্ঠ নিয়েই শিশির বলে ওঠে__
- তুমি আমার আগমনে ভয়.. (কথাটা বলার শেষ না হতেই শাহারিয়ার বলতে শুরু করে)
- সত্যি বলতে অপেক্ষা ভয়ের। অপেক্ষমান প্রতিটা মুহুর্তে মনে হয় তুমি হয়ত আর ফিরবে না আমার অঙ্গনে। হারিয়ে যাবে দূর অজানাতে। কখনো খুঁজে পাবো না তোমায়..
দুজনেই বেশ খানিকক্ষন নিরবতা পালন করে । নিরবতা ঠেলে শাহারিয়ার তার হাতে রাখা ফুলটা এগিয়ে দেয় শিশিরের দিকে। ভুবন ভরানো হাসি দিয়ে শিশির ফুলটা নিয়ে নেয়। দুজনেই নিরব । কিছু সময় বাদে শিশির তার বাম হাতটা দিয়ে শাহারিয়ারের ডান হাতটা ধরে। কম্পিত গলায় বলতে শুরু করে__
- মাঝে মাঝে বড্ড ভয় হয়
- ভয়?
- হ্যা ভয়.. ভয়ের কারণ ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু তোমার কথা বেশি চিন্তা করলে ভয় আমাকে গ্রাস করে।
- হুম .. আসলে তুমি তোমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানটাতে আমাকে বসিয়ে রেখেছো। আর সেই উচ্চতা দেখেই তুমি বার বার কম্পিত হও।
- হুম...হয়তোবা তাই।
কিছুক্ষণ বাদে দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা। শিশিরের বাসা পার্ক এর ডান পাশের রাস্তা ধরে মিনিট দশেকের পথ। প্রতিদিনের মতো আজ তারা রিক্সায় ওঠে না। তাই পার্কের ডান পাশের রাস্তাটা ধরে এগোতে থাকে দুজন। রাস্তাটা বেশ নিস্তব্ধ। একজন অপরজনের নিঃশ্বাস এর শব্দ পর্যন্ত পাচ্ছে। শিশিরের দু'হাত শাহারিয়ারের হাতের কিছুটা উপরে ধরে কাঁধের উপর মাথাটা রেখে হাঁটছে। এইদিকে শাহারিয়ার তার হাত দিয়ে শিশিরের হাত দুটোকে আগলে রেখেছে। এভাবে তারা দশ মিনিটের পথ ত্রিশ মিনিটে পার করেছে। নিজের বাড়ির গেইটটা দেখেই শিশিরের মন খারাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শিশির আদুরে গলা করে বলে__
- বাসায় চলে এলাম কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে না ।
সত্যি বলতে শাহারিয়ারেরও যেতে ইচ্ছা করছে না। তাই কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরবতা পালন করছে। অবশেষে নিস্তব্ধ পরিবেশের নিরবতার বাঁধ ভেঙ্গে শাহারিয়ারের কপালে ভালোবাসার ছোঁয়া দেয় শিশির। শাহারিয়ার বেশ কয়েকবারই শিশিরের কাছ থেকে এ ছোঁয়া পেয়েছে। কিন্তু আজ একটু বেশিই ভালো লেগেছে তার ।।
শিশিরকে বাসায় এগিয়ে দিয়ে শাহারিয়ারের বাসায় ফিরতে বেশ খানিকক্ষণ লেইট হয় । দরজায় নক করতেই তার ছোট বোন এসে খুলে দেয়। শাহারিয়ার ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই হাসি হাসি মুখ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে ছাফা, আর বলে__
- ভাইয়া, তোর জন্য একটা খবর আছে।
- কি খবর?
- সুখবর!
- তাহলে বল .. শুনি।
- আচ্ছা বলব। আগে বল কি দিবি..
- যে কয় প্যাকেট চকলেট চাস .. পেয়ে যাবি।।
শাহারিয়ারের হাতে তার বোন একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়। চিঠিটা দেখেই সে বুঝে ফেলে মুল বিষয়টা। চোখ দু'টো ছলছল করে ওঠে আনন্দে । সপ্তাহখানেক আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সে। ভেবেছিল চাকরিটা বোধহয় হবে না। কিন্তু হয়ে গেছে। বাবা-মা তার রুমে এসেই তাকে মিষ্টি মুখ করিয়ে যায়। তার ইচ্ছা করছে শিশিরকে ফোন করে সব জানাতে। শাহারিয়ার শুয়ে শুয়ে ভাবে এত দিন ওদের বিয়েটা আটকে ছিল এই চাকরিটার জন্য। কারন এই সমাজে চাকরি ছাড়া বিয়ে করতে চাওয়া মস্ত পাপ। আলতু ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে শাহারিয়ার ভাবল ফোনে খবরটা দেওয়া ঠিক হবে না। কাল সকালেই শিশিরকে ফোন করে দেখা করতে বলবে।। তখনই শিশিরকে খবরটা জানাবে সে। তার বাবার বয়স হয়ছে। কিছুদিন পরে রিটায়ার্ড হবে। তাই সব মিলিয়ে চাকরিটা পেয়ে ভালোই হয়েছে।
-কাল ছ'টার দিকে সে ঘুম থেকে ওঠে। জামাত মিস হওয়ায় ঘরে বসেই ফজরের নামাজ আদায় করে সাথে দু' রাকাত শুকরিয়া নামাজও পড়ে সে।। নামাজ শেষে রুম থেকে বেরিয়ে বসার রুমটায় আসে। বসার রুমে আসার সাথে সাথে তার মা বলে__
- কিরে কোথাও বের হবি?
- হ্যাঁ, একটু বের হব।
- আর, হ্যাঁ, দুপুরের আগেই বাসায় আসিস।
শাহারিয়ারের ছোট বোন টিটকারি মেরে বলে__
-ভাইয়া, আজকে তোর সব পছন্দের রান্না হবে বাসায়।
শাহারিয়ার বাসা থেকে বের হবার সময় তার মাকে বলে যায় যে সে আজকে শিশিরকে নিয়ে আসবে, তারপর রাতের দিকে শিশিরকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসবে। শাহারিয়ার তার রুমে গিয়ে শিশিরকে ফোন দেয়। শিশিরকে নীল শাড়ি পরে পার্কের পাশের কফি হাউজটাতে আসতে বলে। সে শিশিরের দেয়া পাঞ্জাবিটা পড়ে বের হয়। একটা রিক্সা ধরে কফি হাউজটার দিকে এগোয়। কফি হাউজটাতে ঢুকেই শিশিরের ফেবারেট দু'কাপ চকলেট ফ্লেভারের কফি অর্ডার করে রাখে । হঠাৎ চোখের উপর একজনের হাতের স্পর্শ অনুভব করে। তার এই স্পর্শ বহু দিনের চেনা। তাই কোন কিছু না ভেবেই বলে __
- শিশির!
- হ্যাঁ।
- চোখ ছাড়া পেয়ে চোখ খুলবে না। আমি বলার পর খুলবে কিন্তু..
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
- এবার খোলো..
শাহারিয়ার চোখ খুলে নীল শাড়ি পরা শিশিরকে দেখতে পায়। প্রথমে তার চোখ আটকে যায় শিশিরের উপর। কিছুক্ষন বাদে মোহ কাটিয়ে শিশিরের হাতের দিকে লক্ষ্য করে। শিশিরের হাতে একটা লাল গোলাপ আর একটা গিফটের প্যাকেট। প্রথমে শিশির শাহারিয়ারের দিকে লাল গোলাপটা এগিয়ে দেয়। তারপর গিফটের প্যাকেট। প্যাকেটের উপরের কাগজে গোটা গোটা করে লেখা "WISH you good lack with my love" লেখাটা দেখেই শাহারিয়ার বুঝে যায় শিশির কোন ভাবে তার চাকরির খবরটা পেয়েছে। আর এটাও বুঝতে বাকি থাকে না যে এটা তার বোন ছাফার কাজ। শাহারিয়ার এসব ভাবতে ভাবতেই শিশিরকে বলে__
- আজ আমাদের অনেক কাজ।
- হুম। জানি।
- প্রথমে শপিংমলে যেতে হবে। তারপর শপিং করে সোজা বাসায় যাব।
- হুম
তারা তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক শপিংমলে যায়। সবার জন্য শপিং করে। শিশিরের জন্য একটা সুন্দর শাড়ি কেনে শাহারিয়ার। শাহারিয়ারকে একটা সুন্দর পাঞ্জাবী পছন্দ করে দেয় শিশির। শপিং সেরে বাসায় আসে দু'জনে। দরজায় নক করতেই শাহারিয়ারের মা দরজা খুলে দেয়। আর হাসি মুখে বলে__
- আরে মা তুমি.. ভিতরে এসো ।।
শাহারিয়ারের মা যত্ন করে শিশিরকে নিয়ে যায় বসার রুমটাতে। শাহারিয়ারও পিছন পিছন পা বাড়ায়। ছুটির দিন হওয়াতে তার বাবা আর ছোট বোন বাসাতেই ছিল। সকলে দুপুরের খাবার খেয়ে এক সাথে বসে জমিয়ে আড্ডা দেয়। বিকেলের দিকে শাহারিয়ার শিশিরকে তার রুমের বেলকুনিটাতে নিয়ে যায়। বেলকুনিটাতে ডাবল সিটের সেমি রকিং চেয়ার রাখা আছে। দু'জনে সেখানটাতে গিয়ে বসে। একজন অপরজনের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশির লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে বলে__
- হেবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছো যে.. কি দেখছো ওমন করে?
- তোমাকে দেখছি
- আমাকে!
- হ্যাঁ, তোমাকে।
- এমন করে তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা করে না বুঝি.. আর আমাকে লজ্জা দিয়ে তুমি তো অপরাধ করছো..
- এটা তো সামান্য অপরাধ করেছি । সম্ভব হলে অনন্তকাল ধরে তাকিয়ে থাকার অপরাধ করতাম।
- যখন বয়স বেড়ে বৃদ্ধা হয়ে যাব। তখন?
-তখনো তাকিয়ে থাকবো। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো কমে নি আর কমবেও না। সেটা বেড়েই চলেছে। আর এই ভালোবাসা বাড়ার কোন সীমা নেই। অনন্ত-অসীম পর্যন্ত বাড়বে এ ভালোবাসা।
বেশ কিছুক্ষণ যাবত দু'জনেই চুপচাপ। একজন অপরজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দু'জনকে দেখে মনে হয় অসীম সময় পার করে দিতে পারবে এভাবে তাকিয়ে। বিকালের সোনালী রোদের আভা এসে পড়েছে শিশিরের মুখে। শাহারিয়ার মুগ্ধ হয়ে দেখছে আর শিশিরের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার অসিমতট সমষ্টির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে শিশিরের প্রতিটা ছোঁয়া। তলিয়ে যাচ্ছে দু'জনে কোন এক অসীম মায়ার জগতে.... দিন কেটে যাবে, সপ্তাহ পেরিয়ে যাবে, মাস পূর্ণ হবে, বছর বছর গুণাঙ্কে যুগ হবে। সময়ের অতলে মানুষ হারিয়ে গেলেও থেকে যাবে ভালোবাসার অম্লান স্মৃতি... এই স্মৃতির শহরে...
+লেখক: মেহেদী হাসান রাব্বি।
এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থী। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার তীব্র ইচ্ছা। ছোট-বড় গল্প ও উপন্যাস পড়ার পাশাপাশি লেখালেখির অভ্যাস আছে।
ফেসবুক আইডি:আইডি লিংক