আত্মহত্যা কোন সমাধান নয় - লিখেছেন - কে এম সিয়াম
-"না মা। আজকে আসব না।"
-"কই থাকবি? হলে?"
-"জি মা।"
আবীর তার হলের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। চায়ের অর্ডার করেছে। রঙ চা। আবীর দুধ চা খায় না। দুধ চা ভালো জমে সিগারেটের সাথে। সিগারেট ছাড়া দুধ চা পানসে লাগে।
পরিবেশটা ঠান্ডা। বৃষ্টির ঘ্রাণ এখনো যায় নি। বৃষ্টি মাটির সাথে মিশে অদ্ভুদ ঘাণ তৈরী করে। এই ঘ্রাণ মানুষকে রোমান্টিক করে তোলে। এই ঘ্রাণ শুঁকে শত শত প্রেম জমে উঠেছে। কিন্তু এই ঘ্রাণ কখনো পুরোনো হয় নি।
চায়ের দোকানে আলোচনা হচ্ছে আত্মহত্যা নিয়ে। এদেশের চায়ের দোকান একেকটা পার্লামেন্ট। নানা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে প্রতিটি চুমুকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার আইনটি বোধ হয় চায়ের দোকানের কথা মাথায় রেখেই দেয়া হয়েছিল।
- "আত্মহত্যাকে লেজিট করা উচিত।" সাজিদ বলল।
-"নাহ। প্রত্যেক ধর্মেই একে নিষেধ করা হয়েছে। "
-"কিন্তু, রাকিব, তুই আমাকে সেকুলার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখা আত্মহত্যা ইললেজিট। আমি তোকে হাজারটা যুক্তি দিতে পারব এর পক্ষে। একজন মানুষের systemic মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার থেকে আত্মহত্যাই বেটার।"
রাকিব কোন যুক্তি বলতে পারছে না। সে চুপ করে গেল। তার এখন চা-ও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
সাজিদ আর রাকিব আবীরের ক্লাসমেট। আবীর চা খেতে খেতে পুরো ঘটনা দেখল। চা শেষ করে ঝেড়ে কাশল। দীর্ঘ বক্তৃতার আগে এমন করে।
-"সাজিদ, শোন, আত্মহত্যা ঠিক তখনই লেজিট হবে যখন তোর জীবনে এমন কিছু ঘটবে যার কাছে তোর জীবন তুচ্ছ। কিন্তু মজার বিষয় হলো জীবনে এমন কিছুই ঘটতে পারে না-যার কাছে জীবন তুচ্ছ।"
- "কিন্তু একজন আত্মহত্যাকারী আত্মহত্যার আগে কতটা মানসিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায় তা কি তুই জানিস?"
- "হুম। অনুধাবন করতে পারি। কারণ আমিও এই রকম সিচুয়েশন পার করেছি। খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ছেকা ক্যারিয়ারে পতন, বড় ধরণের লস, প্রচন্ড মানসিক প্রেসার- এই ধরণের সমস্যার মধ্য দিয়ে মানুষ যেতে পারে। কিন্তু এই সবই জীবনের অংশ।"
- "এতগুলো সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য আত্মহত্যা লেজিট না?!"
- "না। কখনোই না। এগুলো সবই জীবনের অংশ। এগুলো কখনোই জীবনের থেকে বড় হতে পারে না। মানুষের জীবন এত সস্তা না যে এর কোনটার বিনিময়ে জীবন দিয়ে দিতে হবে। বরং জীবন তো এত সমস্যার মাঝে অনেক ভালো এক্সপেরিয়েন্সও দেয়। যে রেজাল্ট খারাপ করে, সে হয়ত খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। যে প্রেমে ছেকা খেয়ে আত্মহত্যা করতে চায়-সে এভাবে চিন্তা করলেই পারে-"যে মানুষ তাকে এত ছোট কারণে ছেড়ে চলে গেল সে যদি তার জীবনসঙ্গী হতো তাহলে তার জীবন বিভীষিকাময় হয়ে যেত।"
সাজিদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আবির তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল-"তুই কি মনে করিস তোর জীবন এতই তুচ্ছ।"
সাজিদ কিছু বলতে পারল না।
সাবারই চা শেষ। রাকিব খুশি মনে স্থান ত্যাগ করল। আবীর টি.এস.সি এর দিকে হাটতে লাগাল। ঢাকা ভার্সিটির ফুটপাতগুলো খুবই আকর্ষণীয়। নিবিড়। শান্ত। আশেপাশের মনরোম হলগুলো এই ফুটপাতকে বিশেষত্ব দেয়।
৮ বছর পরেঃ
আবীর তার ডিপার্টমেন্টের টিচার। ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাস শেষে কতোগুলো কাগজপত্র নিয়ে বসল। সে একটি সংগঠন খুলেছে। ৫ বছর আগে।সংগঠনটি মানসিকভাবে ভালনারেবল মানুষদেরকে খুজে বের করে। তাদের গল্প শুনে। তাদের সমাধান দেয়।
আবীর ভার্সিটি থেকে বের হলো। সে ফুটপাতে হাটছে। আজও বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির সে মোলায়েম ঘ্রাণ সে আজও পায়। তার মনে পড়ে ৮ বছর আগে চায়ের দোকানে দেয়া সেই আড্ডার কথা। তার তিনদিন পরেই সাজিদের আত্মহত্যার ঘটনা। আবীর তার চোখের জল ধরে রাখতে পারে না।
আবীর সাজিদকে বাঁচাতে পারে নি। সে তার গল্পটা বলতে চেয়েছিল, দুঃখের কাহিনী শোনাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তখন শোনে নি।
জীবনের চেয়ে দামী কিছু নেই-সবাই জানে। কিন্তু সবাই অনুধাবন করতে পারে না। সাজিদ অনুধাবন করতে পারে নি। তাকে সাহায্য করা হয় নি।
আবীর এখন মানুষের গল্প শুনে বেড়ায়। ভালনারেবল মানুষকে বাঁচানোই তার প্রধান লক্ষ্য। সে মানুষকে অনুধাবন করায়ঃ "জিন্দেগির থেকে যদি কিছু দামী থাকে, তাহলে তা জিন্দেগি নিজেই।" আবীর সাজিদকে বাঁচাতে পারে নি। কিন্তু তার বদলে বাচিয়েছে শত প্রাণ। সাজিদের গল্প সে শোনে নি; কিন্তু তার বদলে শুনেছে শত গল্প।
মেঘ সরে গেছে। রোদ ঝলমল করছে। দিনের বৃষ্টিতে রংধনু দেখা যায়। আজও তার আবির্ভাব ঘটল। আবীর হাটছে। মানুষের জীবনকে রাঙ্গানোর শক্ত দায়িত্ব সে হাতে নিয়েছে। এ যুদ্ধে যে তাকে সফল হতেই হবে।