২৪শে মে ২০২১ ছিলো বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ, বিপ্লবী ও কথাশিল্পী সোমেন চন্দ এর ১০১ তম জন্মবার্ষিকী।    

সোমেন চন্দ ছিলেন বাংলা সাহিত্যে মার্কসবাদী চেতনা সমৃদ্ধ প্রগতিশীল সাহিত্য ধারায় এক নতুন মাত্রা সংযোজনকারী কথাশিল্পী। তাঁর ছোটগল্পগুলো সমকালীন বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারা থেকে ভিন্নমাত্রার এবং স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত একটি ধারায় অভিষিক্ত।

সোমেন চন্দ বাংলা সাহিত্যের এমন তিন তরুণ সাহিত্যিদের একজন, যাদের কারোই সাহিত্য সাধনার আয়ুস্কাল ছয় বছরের বেশি নয় (সোমেন চন্দের পাঁচ বছর)। বাকি দু'জন হলেন- সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ আগস্ট ১৯২৬ - ১৩ মে ১৯৪৭) ও খান মোহাম্মদ ফারাবী (২৮ জুলাই ১৯৫২- ১৪ মে ১৯৭৪)। তিন জনেরই মৃত্যু হয়েছে ২১ বছর বয়সের পরে এবং ২২ বছর পুরো হওয়ার আগে।


সুকান্তের মৃত্যু হয়েছে যক্ষারোগে- যখন সে রোগের নিরাময় সম্ভব উন্নত চিকিৎসা সহজ ছিলো না। ফারাবীর মৃত্যু হয়েছে মারণব্যাধি কর্কট রোগে। ক্যানসারের বিশেষ কোনো চিকিৎসার উপায়ও তখন ছিলো না। সোমেন চন্দের মৃত্যু হতে পারতো ডাবল নিউমোনিয়া কিংবা যক্ষায়ও। কিন্তু  তা হয়নি- তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।  
   


মার্কসবাদী বিপ্লবী ও কবি হিসেবে সুকান্ত বিপুল জনপ্রিয়। মার্কসবাদী চেতনার ধারক ফারাবীও শিশুসাহিত্যিক- নাট্যকার- মননশীল প্রাবন্ধিক ও কবি। আর সোমেন চন্দকে বলা যেতে পারে মার্কসবাদী চেতনা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও প্রগতি সাহিত্য সংঘের এক তারকা।  

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েনই সোমেন চন্দকে মার্কসবাদী হয়ে উঠার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্বাস করতেন সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে। আর এ কারণেই তার লেখায় অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। আর এজন্যই তিনি সাহিত্যেকে সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার বলেই মনে করতেন। সাহিত্যকে তিনি মানুষকে সংগ্রামী করে তোলার অনুপ্রেরণা সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম বলে মনে করতেন। আর সেই লক্ষ্যেই  তিনি মানুষের মুক্তি চেতনাকেই ধারণ  করেছেন তার সৃষ্টিতে।

এ প্রসঙ্গে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন:
"মার্কসবাদী শ্রেণীচেতনার আলোকে সোমেন চন্দ নির্মাণ করেছেন তাঁর ছোটগল্পের প্রিয় মানুষদের। বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ সোমেন চন্দের ছোটগল্পেই প্রথম সচেতনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘সংকেত’, ‘একটি রাত’, ‘দাঙ্গা’, ‘বনস্পতি’, ‘ইঁদুর’ প্রভৃতি গল্পের কথা স্মরণ করা যায়। নিম্নবর্গের সংগ্রামশীল জীবন সোমেন চন্দের ছোটগল্পের প্রধান শিল্প-উপকরণ; ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামে নিম্নবর্গের দীপ্র অভ্যুত্থানই সোমেনের ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়।"

বিপ্লবী কথাশিল্পী শহীদ সোমেন চন্দ ১৯২০ সালের ২৪ মে নরসিংদী জেলার আশুলিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
শিশুকাল থেকে সোমেন চন্দ বই খোঁজার আগ্রহেই পাঠাগারমুখী হন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের পরিচালিত ঢাকার জোড়পুল লেনের প্রগতি পাঠাগারে পড়তে পড়তে সোমেন বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৩৬ সালে তিনি পোগোজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৭ সালে তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল (বর্তমান শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল) এ ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু তিনি ১৯৩৯ সালে ডাবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

পরিবারের সবার অগোচরেই স্কুল জীবন থেকে গল্প লিখতেন সোমেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে (১৯৩৭) সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশ পায় সোমেনের প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’। এর পর আরও কিছু লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ওই বছরেই প্রকাশিত হয়। ১৭ বছর বয়সেই বাংলাদেশে বন্যার দুর্যোগ ও দুর্ভোগ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং সোমেনের একমাত্র উপন্যাস ‘বন্যা’ প্রকাশিত হয় নবশক্তি পত্রিকায়।

তিনি 'প্রগতি লেখক সংঘ' এ যোগদান করেন এবং মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সংঘের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃতকৃমার দত্ত, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী আরও জড়িত ছিলেন অচ্যুৎ গোস্বামী, সদানন্দ সেন, অমৃতকুমার দত্ত, সত্যেন সেন প্রমুখ। ১৯৪১ সালে সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন। সোমেন চন্দের লেখা গুলো সাধারণত প্রগতি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সভায় পাঠ করা হত।  

১৯৪০ সালে তার "বনস্পতি" গল্পটি "ক্রান্তি" পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৪১ সালের দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সোমেন গল্প লেখেন দাঙ্গা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সব জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে যার মধ্যে ঢাকা শহর ছিলো অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবি ও লেখকদের নিয়ে শহরে এক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করা হয়; আয়োজন করা হয় হয় চিত্র প্রদর্শনীর। স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও কমরেড জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলন উপলক্ষে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে ছিলেন জাতীয় বিপ্লবী, বিশেষত শ্রীসংঘ ও বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, তৃতীয় পক্ষ কংগ্রেস অনুসারীরা তুষ্ণীভাব অবলম্বন করেছিলেন।

সূত্রাপুর সেবাশ্রমের কাছে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টির (আর এস পি) গুন্ডারা সোমেন চন্দের উপর হামলা চালায় বলে ধারণা করা হয়। তখন তিনি সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্যোগে রেলওয়ে কর্মীদের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সম্মেলন স্থলে যাচ্ছিলেন। রাস্তার ওপরেই নিহত হন এই তরুন শ্রমিক নেতা। বয়স মাত্র ২১ বছর ৯ মাস ১৫ দিন।

ব্যক্তি সোমেন চন্দকে বাঁচতে দেয়নি জাতীয়তাবাদীরা, যদিও তারাও ছিলেন দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাকামী- কিন্তু উগ্রতার জন্যই বিভ্রান্ত। উগ্রপন্থা কতোটা নৃশংস হতে পারে যে সোমেনকে মেরে ফেলে তার জিহ্বা কেটে নিয়ে রাস্তায় নৃত্য করেছিলো হত্যাকরীরা! সোমেনের সংগ্রামের যে ধারাটি তা কিন্তু অনিঃশেষ। পৃথিবী জুড়ে এখনও লড়াই চলছে; সমাজ পরিবর্তনকামী মানুষ, পুঁজিবাদ- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে- বিকল্পহীন এক সংগ্রাম।
 
তার মৃত্যুর পর প্রগতি লেখক সংঘ 'প্রতিরোধ' নামে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। তার অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে শিশু তপন, ইঁদুর, সংকেত, বনস্পতি, দাঙ্গা, সত্যবতীর বিদায়, ভালো না লাগার শেষ, উৎসব, মুখোশ ইত্যাদি গল্প। তার ১টি উপন্যাস, ২৮টি গল্প, ৩টি কবিতা, ২টি নাটক সহ তাঁর লেখা চিঠির সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তার 'ইঁদুর' গল্পটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এই মহান লেখকের সম্মানার্থে "সোমেন চন্দ পুরস্কারের" প্রবর্তন করেছে কলকাতা বাংলা একাডেমি।

১৯৭৩ এ বাংলাদেশ প্রথম রণেশ দাশগুপ্ত তার গল্পসমূহের একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেন "সোমেন চন্দের গল্প সংগ্রহ" নামে। ১৯৯২ এ বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত "সোমেন চন্দ রচনাবলী"। বাংলাদেশে সোমেন চন্দের একমাত্র জীবনীগ্রন্থ
হায়াৎ মামুদ রচিত "সোমেন চন্দ" ১৯৮৭ তে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।    

বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ সোমেন চন্দের প্রতি রইলো অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলী। 


সোমেন চন্দের বিখ্যাত গল্প "ইঁদুর" পড়ুন এই লিংকেলিংক

বাবুল আশরাফ
জন্ম: ১১সেপ্টেম্বর ১৯৫৯। হামিরদী-ভাঙ্গা-ফরিদপুর। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, রিজিয়া বেগম মহিলা কলেজ, শিবচর, মাদারীপুর।