আমি কবির হোসেন। ফার্মগেটের একটা বইয়ের দোকানের কর্মচারী। কেমোথেরাপী দেওয়ার ঠিক আগে ১০-১২ হাজার টাকার ঔষুধ লাগে। ২য় কেমো'টা দেয়ার পর বাবা সুস্থই ছিলেন, ভেবেছিলাম ৩য়টায় সেরে যাবেন। কিন্তু ৩য় টায় পর থেকে শরীরের অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হচ্ছে। ফুসফুসের ক্যান্সার যে কি ভয়ংকর। ৩টা কেমো'র খরচা যোগাতে আমি প্রায় সব বিক্রি করে ফেলেছি। বাবার দেয়া ৮ আনা সোনার নাকের নথটা বাদে বউয়ের গহনাও এক ফোঁটা বাদ নেই। কিচ্ছু বাদ নেই, কোথাও কিচ্ছু বাদ নেই। ওদিকে ৩ মাস ভারী ভাড়া বাকী, মেয়েটার ফরম ফিলাপের টাকা দেওয়ার লাস্ট ডেট কালকে। তাতে লাগবে ১০ হাজার ৭২০ টাকা । আমার কাছে ১১ হাজার টাকা আছে। ছোটবেলার বন্ধু সোবাহানের কাছ থেকে চড়া সুদে ৮ হাজার টাকা, আর ৩ হাজার টাকা দোকান থেকে চুরি করেছি। বুড়ো দোকান মালিকের দুই মাসের অগ্রীম বেতন নিয়ে বাবার ৩য় কেমো'তে জুরেছিলাম। জীবন কত নিষ্ঠুর !!! এখন আমাকে মেয়ের পরীক্ষা আর বাবার জীবনের মধ্যে কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে দেড় ঘন্টা হাসপাতালের করিডোরের চেয়ারে যে কখন কেটে গেছে টের পাইনি। আজ বাবার সাথেই রাতে থাকার কথা। চোখ মুছে বাবার কাছে গেলাম। বাবা ঘুমাচ্ছেন, আমি যখন ৩য় বার মেট্রিক পরীক্ষা দেই, টাকার অভাবে আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। শেষদিন হঠাৎ বাবা কই থেকে যেন টাকা নিয়ে এলেন। সব ঠিক হয়ে গেল, বংশে প্রথম আমি মেট্রিক পাস করলাম। আবার বুক ভরে কান্না এল। কিন্তু অনেকক্ষণ কাঁদার পর মানুষ আর কাঁদতে পারে না, চাইলেও পারে না। বাবার পাশের বেডের সালাম সাহেব কালকে মারা গেছেন। ওয়ার্ডে বাকী সবাই ঘুমিয়ে পরেছেন। সালাম সাহেবের লালা লাগা বালিশটা ধরে ২ মিনিট নাড়াচাড়া করে উঠে পরলাম। সোজা বাসায় চলে এলাম।


ভোর ৬ টায় উঠে কাগজে মোড়ানো টাকাগুলো রাবেয়ার হাতে দিয়ে বললাম-

    -এই নাও মেয়েটের ফরম ফিলাপটা করে ফেল। এসবে দেরী করতে হয় না

    -ওমা, তুমি টাকা ঝোগাড় করলে কিভাবে ?

    -এক বন্ধুর কাছ থেকে এনেছি

    -আমি তো ভেবেছিলাম শেষমেশ তুমি টাকাটা ঝোগাড় করতে পারবে না। তাই পরশু আমার নথটা বিক্রী করে ওর ফর্ম ফিলাপ আর বাড়িওয়ালার দুই মাসের পাওনা দিয়ে দিয়েছি ।

    -আমাকে একবার বলতেও পারতে

    -তুমি বাবার চিকিৎসা নিয়ে দিন রাত খাটছ, আমি ভাবলাম সংসারটা  এদিক থেকে আমি একটু সামলে নেই। ভালোই হল ঐ টাকা দিয়ে বাবার ঔষুধগুলো হয়ে যাবে।

    -বাবার আর ঔষুধ লাগবে না, কোনদিনও না...


কবির সাহেবের বাবা তার পিতৃত্ব পরিপুর্নভাবে পালন করে গেলেন..।  


+লেখক: মো. নাফিজ ইমতিয়াজ  

একাধারে সামাজিক ও আধুনিক উম্মাদ। কিন্তু বয়ে চলায় বিশ্বাসী।

ফেসবুক:আইডি লিংক