নাটোরের রাণীভবানী ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী মহারাণী ভবানী’ নামে দেশে বিদেশে পরিচিত। রাজকার্য পরিচালনায় রাণীভবানী যেমন দক্ষ ও বিচক্ষন ছিলেন, একজন দানশীল রমনী হিসাবে তাঁর অবদান-খ্যাতি তার চেয়েও অধিক ছিল।তাঁর ধার্মিকতা,দানশীলত, প্রজাকল্যাণ মাহাত্ম্য মনে রাখবার চেয়ে ভুলে যাওয়া বড়ই কঠিন। তিনি ছিলেন প্রাতঃস্মরণীয়া।



১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম হয় রাণীভবানীর। রাণীভবাণীর পৈতৃক নিবাস ছিল বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামে। পিতা আত্মারাম চৌধুরী ও মাতা জয় দেবী এর কন্যা ছিলেন তিনি। তার বিয়ে হয় মাএ ১৫ বছর বয়সে। তাঁর স্বামীর নাম রাজা রামকন্ত।রাণীভবাণীর বিয়ে অনুষ্ঠান খুব ধুমধাম হয়।মহীয়সী মহারাণী দেখতে ছিলেন পরমা সুন্দরী এবং সুলক্ষণযুক্তা। রাণীভবাণীর গর্ভে জন্মে দুই পুএ ও এক কন্যা। পুত্র সন্তান দুটি অকালে মারা যায়।একমাত্র কন্যার নাম ছিল তাঁরাসুন্দরী দেবী। ১৭৪৮ সালে খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামকান্ত হঠাৎ পরলোক গমন করলে মাএ বএিশ বছর বয়সে বিধবা হয়ে পড়েন রাণীভবাণী। কন্যা তাঁরাসুন্দরীর বিয়ে হয় নাটোরের খাজুরা গ্রামের রঘুনাথ লাহিড়ীর সঙ্গে। রাণীভবানীর জামাতা রঘুনাথ ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে অকাল মৃত্যুর শিকার হলে কন্যা তারা সুন্দরীও অতি অল্প বয়সে বৈধব্য বরণ করেন।




রাজশাহী জমিদারির সদর দফতর ছিল নাটোর। রাজশাহী জমিদারি তৎকালে ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা বড় জমিদারি ছিল বলে অনেকের অভিমত।রাজশাহী রাজা বা রাজশাহী প্রদেশ নামেও রাজশাহী জমিদারির পরিচিতি ছিল। রাণীভবানী প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ রাজশাহী রাজ্যের শাসনভার পরিচালনা করেন।রাণীভবাণী সুদীর্ঘ কালের শাসনামলে প্রজাদের জীবন কেটেছে স্বাচ্ছন্দ্যে-শান্তিতে। আস্থাভাজনদের চাটুকারিতা,ইংরেজ শাসনামলে লর্ডক্লাইভের দ্বৈতশাসন,জেনারেল হেস্টিংসের কোম্পানি আইনের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি কারণে রাণীভবানীর রাজ্যশাসনে তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই এক নাগাড়ে ৫০ বছর রাজ্যশাসন করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।



নবাব আলীর্বদী খাঁনের আমলে রাণীভবানীর স্বামী রাজা রামকান্ত মারা যান। রাণীভবানী তখন তাঁর জামাতা রঘুনাথের হাতে নাটোরের রাজ্যভার অর্পণ করেন। এজন্য তাঁকে নবাব দরবারের স্বীকৃতি নিতে হয়েছিল। সে সময় রাজশাহী প্রদেশের সদর দপ্তর নাটোর ছিল কোলকাতা থেকে দশ দিনের পথ। রাণীভবানীর রাজ্য প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগতো পঁয়ত্রিশ দিন। আর সত্তর লক্ষ সিক্কা টাকা রাজ্যের বার্ষিক কর প্রদানের জন্য নির্ধারিত ছিল কিন্তু তাঁর প্রকৃত আদায় ছিল দেড় কোটি সিক্কা টাকা। রাণীভবানীর আমলেই রাজশাহী জমিদারির রাজ্য সীমা সর্বাধিক ব্যাপ্তি লাভ করে।




রাণীভবানীর শাসনামলে মারাঠা-বর্গী হাঙ্গামায় অতিষ্ঠ হয়ে নবাব আলীবর্দি খাঁন মুর্শিদাবাদ থেকে দরবারে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপএ পদ্মাতীরের গোদাগাড়ীতে স্থানান্তরিত করেন। গোদাগাড়ী ছিল রাণীভবানীর এলাকা। গোদাগাড়ীতে আজো অতীতের সাক্ষী হয়ে আছে নবাব আলীবর্দি খাঁন নির্মিত কেল্লার ধ্বংসাবশেষ। মীর জাফরের দোসর নন্দকুমারের চক্রান্তে রাণীভবানী ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিছুকালের জন্য রাজ্যচ্যুত হন। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গর্ভনর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস সমগ্র ভারতের গর্ভনর জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার আইন বলে। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জমিদারী দিয়ে দেওয়া হয় জনৈক দুলাল রায়কে।




রাণীভবানী কাশীধামে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন, যার নাম ‘ভবানী মন্দির’। সেখানে তিনি ৩৮০ টি ধর্মমালা, অতিথিশালা,রাজপথ ও ব্রাহ্মণভোজন কেন্দ্র,আদিকেশরের ঘাট,পিশাচ মোহন পুষ্করিণী প্রভৃতি নির্মাণ করেন। মুসলমান প্রজাদের জন্যও রাণীভবানীর অসামান্য দান বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মুসলিম পীর অলিদের জন্য তিনি পীরোত্তর সম্পত্তি দান করেন। নারীদের কর্মসংস্থানে তিনি অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। রাণী ভবানী ৭৪ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করে এবং বড় নগরে গঙ্গাতীরে বাস করতে থাকেন। তাঁর অর্থের খুব সংকট ছিল। কোম্পানির দেওয়া এক হাজার টাকা মাসোহারাই ছিল তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন। ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে বড়নগরে দেহত্যাগ করেন নাটোরের সেই মহারাণী ভবানী। সৎকর্মে কীর্তিময়ী রাণী ভবানী আজও কালজয়ী।
তথ্যসংগ্রহ: ড.মো. রাজ্জাকুল ইসলাম (উওরা গণভবনের) -উপসচিব।
লেখিকা: সাদিয়া তাহসিন মিম। 
ইতিহাস সম্পর্কে জানতে  পছন্দ করি। মাঝে মধ্যে কবিতাও লিখি। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ যত বেশি বেশি জানবে তার এর প্রতি আগ্রহ আরও প্রবল হতে থাকবে।